প্রস্রাবের রঙ হলুদ মানেই কি জন্ডিস? প্রস্রাবেই লুকিয়ে আছে ভয়ংকর বিপদে!
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৬-৮ বার প্রস্রাব করেন, যার মোট পরিমাণ প্রায় ১.৪ লিটার। এটি শুনতে সাধারণ মনে হলেও, প্রস্রাবের রঙ, গন্ধ বা পরিমাণ আমাদের শরীরের ভেতরের নানা পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সংকেত দেয়। চিকিৎসকরা তাই অনেক সময় রোগ নির্ণয়ের জন্য ইউরিন টেস্ট (Urine Test) করে থাকেন, কারণ প্রস্রাবের রঙ ও রাসায়নিক উপাদানগুলো থেকেই জানা যায় -আপনার শরীরে কোনো রোগ আছে কি না, যেমন ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা বা লিভারের সমস্যা ইত্যাদি। আজকের আর্টিকেলে আমরা জানব — ১) প্রস্রাবের স্বাভাবিক অবস্থা ২) প্রস্রাবের রঙ দেখে কোন রোগের ইঙ্গিত পাওয়া যায় ৩) প্রস্রাব ভালো রাখার উপায়। চলুন ধাপে ধাপে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক। ইউরিনারি সিস্টেম বা মূত্রতন্ত্র সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা: আমাদের শরীরে যে অঙ্গগুলো মূত্র উৎপাদন ও নির্গমনের কাজ করে, তাকে বলে Urinary System (মূত্রতন্ত্র)। এর প্রধান অংশগুলো হলো: Kidney (কিডনি): মটরশুঁটির আকৃতির দুটি অঙ্গ, যা রক্ত পরিশোধন করে ও মূত্র তৈরি করে। Ureter (ইউরেটার): কিডনি থেকে মূত্রকে মূত্রথলিতে নিয়ে যায়। Urinary Bladder (মূত্রথলি): এখানে মূত্র জমা থাকে। Urethra (ইউরেথ্রা): এই নালির মাধ্যমেই মূত্র শরীর থেকে বের হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মূত্রথলিতে একবারে প্রায় ৪০০-৬০০ মিলিলিটার প্রস্রাব জমতে পারে, যা প্রায় দুই কাপ চায়ের সমান। যখন মূত্রথলি পূর্ণ হয়ে যায়, তখন স্নায়ুতন্ত্র (Nervous System) মস্তিষ্কে সিগন্যাল পাঠায়, ফলে আমাদের প্রস্রাবের বেগ হয়। প্রতিদিন কতটা প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক? সাধারণভাবে একজন সুস্থ মানুষ দিনে ০.৬ লিটার থেকে ২.৫ লিটার পর্যন্ত মূত্রত্যাগ করেন। গড়ে এর পরিমাণ ১.৪ লিটার। যদিও প্রস্রাবের পরিমাণ নির্ভর করে নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর: আপনি প্রতিদিন কতটা পানি পান করছেন, কারন পানি বেশি খেলে প্রস্রাব বেশি হবে। আপনার কাজের ধরন (অফিস বা ফিল্ড ওয়ার্ক), আপনি রোদে কাজ করলে প্রস্রাবের পরিমাণ কম হবে। এঝাড়া পরিবেশের তাপমাত্রা এবং মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উপর প্রস্রাবের পরিমাণ নির্ভর করে। Polyuria: স্বাভাবিক ভাবে কেউ যদি প্রতিদিন ২.৫ লিটারের বেশি প্রস্রাব করে তখন তাকে Polyuria বলে। Oliguria: কেউ যদি প্রতিদিন ৪০০ মি.লি কম প্রস্রাব হলে তাকে Oliguria বলে। এই দুই অবস্থাই অস্বাভাবিক এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রস্রাবের সময় শরীরে ঝাঁকুনি” বা কাঁপুনি দেয় কেন? অনেকেই লক্ষ্য করেন, প্রস্রাব শেষে শরীরে হালকা “ঝাঁকুনি” বা কাঁপুনি আসে। এটিকে বলে Post Micturition Convulsion Syndrome। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং Autonomic Nervous System এর একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। প্রস্রাবে কি কি উপাদান থাকে? প্রস্রাবে অনেক রাসায়নিক উপাদান থাকে। প্রায় ৯৫% পানি এবং ৫% বিভিন্ন জৈব (Organic) ও অজৈব (Inorganic) উপাদান। Organic Components: Urea Uric acid Urobilinogen Creatine Amino acid Hormones Inorganic Components: Sodium Potassium Calcium Magnesium Chloride Phosphate Sulphate এই উপাদানগুলোর কারণেই প্রস্রাবের রঙ, গন্ধ ও স্বাদে পার্থক্য দেখা যায়। যেমনঃ Sodium এর কারনে প্রস্রাবের স্বাদ লবণাক্ত হয়। Phosphate এর কারনে দুর্গন্ধ আসে। Urobilinogen এর কারনে প্রস্রাবের রং হলুদ হয়। প্রস্রাবের রঙ কেমন হওয়া উচিত? প্রস্রাবের স্বাভাবিক রঙ হলো হালকা হলুদাভ থেকে গাঢ় হলুদাভ (pale yellow to amber)। এখন প্রশ্ন আসতে পারে — উভয় রঙ কীভাবে স্বাভাবিক? এর কারণ হলো Urobilinogen, যা রক্তের লোহিত কণিকা (RBC) ভেঙে তৈরি হওয়া Bilirubin থেকে উৎপন্ন হয়। Bilirubin এর রঙ হলুদ, তাই এটি প্রস্রাবের রঙকেও হলুদ করে তোলে। যদি আপনি বেশি পানি পান করেন → প্রস্রাব পাতলা → রঙ হালকা। যদি আপনি কম পানি পান করেন → প্রস্রাব ঘন → রঙ গাঢ় । এই দুই অবস্থাই স্বাভাবিক। প্রস্রাবের রঙ অনুযায়ী শরীরের অবস্থা চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক— প্রস্রাবের রঙ সম্ভাব্য কারণ সমাধান হালকা হলুদ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক চিন্তার কিছু নেই গাঢ় হলুদ পানি স্বল্পতা, ঘাম, রোদে কাজ, ভিটামিন B বা মাল্টিভিটামিন দিনে ২–৩ লিটার পানি পান করুন সাদা/গোলাটে অতিরিক্ত পানি পান, ডায়াবেটিস, কিডনিতে পাথর, ইউরিন ইনফেকশন পানি পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন ব্রাউনিশ/হালকা বাদামী পানি স্বল্পতা, লিভারের সমস্যা পানি বাড়ান, সমস্যা না কমলে পরীক্ষা করুন লাল বা গোলাপি প্রস্রাবে রক্ত, কিডনিতে পাথর, ইনফেকশন বা ক্যান্সার জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের কাছে যান কালচে বাদামী (কোকাকোলা রঙ) লিভারের মারাত্মক সমস্যা, পিত্তথলীর পাথর, তীব্র পানি স্বল্পতা দ্রুত চিকিৎসা নিন বিশেষ দ্রষ্টব্য: ড্রাগন ফল বা বিটরুট খেলে সাময়িকভাবে প্রস্রাবের রঙ লালচে হতে পারে — এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি? নিচের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যান: ১) প্রস্রাবের সময় চুলকালী, জ্বালাপোড়া, ব্যথা বা অস্বস্তি ২) ঘন ঘন মূত্রত্যাগ, কিন্তু পরিমাণ অল্প ৩) প্রস্রাবের রঙ লাল, কালচে বা অতিরিক্ত গাঢ় ৪) প্রস্রাব ঘোলাটে বা ফেনাযুক্ত ৫) প্রস্রাব শরীরে পড়ে যাচ্ছে বা দুরত্বে ছিটকে যাচ্ছে না (Prostate gland সমস্যা হতে পারে) প্রস্রাব সুস্থ রাখার ৫টি জরুরি টিপস ১) প্রতিদিন ২–৩ লিটার পানি পান করুন। তবে অতিরিক্ত গরমে বা শরীরচর্চার পর আরও বেশি পানি দরকার। ২) প্রস্রাব চেপে রাখবেন না। এতে ব্যাকটেরিয়া জমে ইনফেকশন হতে পারে। ৩) পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান। অতিরিক্ত ঝাল, তেল, লবণ ও প্রসেসড খাবার এড়িয়ে চলুন। ৪) নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এটি কিডনির রক্তসঞ্চালন ও কার্যকারিতা বাড়ায়। ৫) প্রস্রাবের রঙে পরিবর্তন দেখলে গুরুত্ব দিন। হালকা পরিবর্তন হলে পানি বাড়ান, বড় পরিবর্তন হলে চিকিৎসা নিন। অতিরিক্ত কিছু পরামর্শ রাতে ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত পানি না খাওয়াই ভালো। দীর্ঘসময় প্রস্রাব ধরে রাখা মূত্রথলি দুর্বল করে। ক্যাফেইন (চা, কফি) ও অ্যালকোহল প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়ায়, তাই পরিমিতভাবে গ্রহণ করুন। প্রস্রাবের রঙে হঠাৎ পরিবর্তন হলে নিজে থেকে ওষুধ খাবেন না। প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ Section) ১) প্রস্রাবের রঙ কেন পরিবর্তন হয়? প্রস্রাবের রঙ পরিবর্তনের মূল কারণ হলো শরীরের পানি ভারসাম্য, খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ গ্রহণ, এবং কিডনি বা লিভারের কার্যকারিতা। কখনও কখনও ভিটামিন, ফল বা শাকসবজির রঙও ইউরিনের রঙে প্রভাব ফেলে। ২) কোন রঙের প্রস্রাব সবচেয়ে স্বাভাবিক? সবচেয়ে স্বাভাবিক রঙ হলো হালকা হলুদ থেকে অ্যাম্বার (amber)। এটি বোঝায় আপনি পর্যাপ্ত পানি পান করছেন এবং শরীরের কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে। ৩) প্রস্রাবের রঙ যদি লাল বা বাদামী হয়, তাহলে কী করব? প্রস্রাবের রঙ যদি লাল, বাদামী বা কালচে হয়, তাহলে এটি রক্ত, লিভার বা কিডনি সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে। এই অবস্থায় অবিলম্বে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে ইউরিন টেস্ট ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। ৪) অতিরিক্ত পানি খেলে কি সমস্যা হতে পারে? হ্যাঁ, অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ফলে ইউরিন একদম রঙহীন হয়ে যেতে পারে, যা কিডনিতে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। তাই পরিমিতভাবে — দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করাই সর্বোত্তম। উপসংহার: প্রস্রাবের রঙ শুধু শরীরের পানি ভারসাম্যের নয়, কিডনি, লিভার ও মেটাবলিক স্বাস্থ্যেরও প্রতিফলন। তাই প্রতিদিন নিজের ইউরিনের রঙ লক্ষ্য করুন, পানি পরিমাণ ঠিক রাখুন এবং কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
প্রস্রাবের রঙ হলুদ মানেই কি জন্ডিস? প্রস্রাবেই লুকিয়ে আছে ভয়ংকর বিপদে! Read More »
