কুকুর কামড়ালে যে ৪ টি কাজ কখনোই করা যাবে না।

সেয়ার করুনঃ

কুকুর কামড়ালে রেবিস বা জলাতঙ্ক হয়। প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি মানুষ শুধু মাত্র কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়। প্রতি বছর ৫৯০০০ মানুষ মারা যায় শুধু মাত্র রেবিস বা জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে। এর মধ্যে ৯৫% হচ্ছে এশিয়া এবং আফ্রিকাতে। রেবিস বা জলাতঙ্কে কেউ আক্রান্ত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত, এর কোন চিকিৎসা নেই। তাই রেবিস বা জলাতঙ্ক সম্পর্কে সচেতনতার বিকল্প নেই।

সূচিপত্রঃ

রেবিস বা জলাতঙ্ক কি?

রেবিস (Rabies) হচ্ছে আরএনএ ভাইরাস যা লিসা ভাইরাস গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাহে রেবিস বা জলাতঙ্ক বলা হয়। রেবিস মূলত একটি Zoonotic রোগ (অর্থাৎ এই রোগ টি প্রানী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়)। রোগ তত্ত্ব গবেষনা ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের তথ্য মতে প্রতি দিন গড়ে ৬০০/৭০০ মানুষ কুকুরে কামড়ে আক্রান্ত হয়। তাই রেবিস বা জলাতঙ্ক নিয়ে আমাদের আতঙ্কের শেষ নেই।

কুকুর কামড়ালে

রেবিস ভাইরাস কোথায় থাকে?

মুলত বেরিস ভাইরাসে আক্রান্ত কোন প্রাণীর লালা গ্রন্থি (salivary gland) থেকে নিঃসৃত রস ( লালা ) ও স্নায়ুতে এ ভাইরাস অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে যেকোন ভাবে ভাইরাস সুস্থ মানুষের রক্তে প্রবেশ করলেই মানুষ এই রোগের আক্রান্ত হয়। অথবা যদি কোনভাবে ভাইরাস সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সেক্ষেত্রেও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। প্রথমে ভাইরাসটি ক্ষত স্থানের নার্ভটিস্যুতে প্রবেশ করে এবং প্রতিদিন ১২-২৪ মিলিমিটার করে মস্তিষ্কের (Brain & spinal cord) দিকে এগুতে থাকে। রেবিস ভাইরাস একবার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে মৃত্যু ১০০% নিশ্চিত।

কিভাবে রেবিস ছড়ায়?

 শতকরা ৯৩% কুকুড়ের কামড়ে মানুষের মধ্যে এ রোগ হয়। তাছাড়া বাকি ৭% বিড়াল, শেয়াল, বানর, বাদুর, গরু, ঘোড়া, বেজি ইত্যাদি প্রানীর কামড় বা আচরে এই রোগ হতে পাড়ে। “এখানে একটি কথা জেনে রাখা প্রয়োজন” সুস্থ কুকুর বা প্রাণী কামড় দিলে বা আচর দিলে রেবিস হয় না । শুধু মাত্র রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুর (পাগলা কুকুর) বা প্রানী কামড় দিলে, আচর দিলে অথবা কাটা স্থান বা ক্ষতস্থানে চেটে দিলে সে ব্যক্তি রেবিসে আক্রান্ত হন ইহা নিশ্চিত ।

কুকুর কামড়ালে

কিভাবে বুঝবেন কুকুর বা প্রানী টি রেবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা?

সত্যি বলতে নিশ্চিত করে বুঝা সম্ভব না, তবে কিছু লক্ষ্যণ দেখে অনুমান করা যায় যেমন।

      • কুকুরটির মুখে অতিরিক্ত লালা ঝড়বে এবং নিস্তেজ বা আড়ালে থাকতে পছন্দ করবে।

      • পাগলাটে বা খেপাটে আচরন করবে।

    তারপর ও যদি কুকুরটি সম্মন্ধে ১০০% নিশ্চিত না হতে পারেন তাহলে একটু ও দেরি না করে দ্রুত রেবিস ভ্যাকসিন (টিকা) নেওয়া উচিত। কারন একবার রেবিসে আক্রান্তু মৃত্যু নিশ্চিত। তাই কোন রকম রিক্স না নিয়ে দ্রুত টিকা নিতে হবে।

    কুকুর কামড়ালে প্রথমে কি করবেন?

    কুকুর কামড়ালে প্রথমেই ক্ষারযুক্ত সবান দিয়ে ১৫ মিনি ধরে ধুয়ে ফেলুন, কারন সাবানের ক্ষার ভাইরাসকে ধ্বংস করে। যেহেতু একবার রেবিস ভাইরাসে আক্রন্ত হয়ে গেলে এর কোন চিকিৎসা নেই। কুকুর বা বিড়াল কামড় দিলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে । যেমন রেবিস ভ্যাক্সিন দেয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) এর মতে কুকুর বা বিড়াল কামড় দিলে তিনটি ক্যাটাগরি তে ভাগ করা যায়।

    প্রথমে আসছি ক্যাটাগরি -১: যারা বলেন কুকুর বা বিড়াল গায়ে পাড়া দিয়েছে, গায়ের সাথে লেগেছে, চেটেছে বা লেজের বাড়ি লাগছে, কিংবা নখের খুচা লাগছে কিন্তু রক্ত পরে নাই, কোন জ্বালা করে না। এসব গুলো ক্যাটাগরি -১। অথাৎ কোন রক্তপাত ঘটে নি সে গুলোকে ক্যাটাগরী-১ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ক্যাটাগরী-১ এর ক্ষেত্রে কোন টিকা নেয়ার পয়োজন নেই। যেটা করতে হবে, কোন এন্টিসেপ্টিক দিয়ে পরিষ্কার করুন। অথবা সবান দিয়ে ১৫ মিনি ধরে ধুয়ে ফেলুন। কারন সাবানের ক্ষার ভাইরাসকে ধ্বংস করে।

    ক্যাটাগরি – ২ঃ যদি পশুর আঁচড়ের দাগ দেখা যায় কিন্তু রক্ত আসে নাই তাহলেই ক্যাটাগরি-২। অথাব নোখের আচরে হালকা রক্তপাত হয়েছে কিংবা জ্বালা পোড়া করছে সেটাও ক্যাটগরী-২ এর অন্তভুক্ত হবে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থান ক্ষার যুক্ত সাবান দিয়ে কমপক্ষে ১৫ মি ধুইতে হবে। তারপর রেবিস ভ্যাকসিন দিতে হবে (যা বাজারে Rabipur নামে পাওয়া যায়) ।

    কুকুর কামড়ালে কয়টি টিকা নিতে হবে?

    কুকুর কামড়ালে ৫টি টিকা দিতে হয়। অবশ্যই হাতের মাংসপেশি (deltoid muscle) এ দিতে হবে, ২ বছরের কম শিশুদের পায়ের উরুতে দিতে হবে। কোন ভাবেই নিতম্বে (buttock) দেয়া যাবে না)।

     কিভাবে দিতে টিকা হবে?

    ৫ টি টিকার ডোজ হচ্ছেঃ ০,৩য়,৭ম,১৪তম,২৮ তম দিনে দিতে হবে। অথাৎ টিকা শুরু করার পরে ২৮ দিনের মধ্যে ৫ টি ইনজেকশন দিতে হবে। তবে বর্তমানে চামড়ার নিচে ৪টি টিকা দেয়া হয়। ০.২ মিলি করে বাহুতে চামড়ার নিচে ০,৩য়,৭ম ,২৮ তম দিনের হিসেবে দেয়া হয়।

    ক্যাটাগরি -৩ঃ কুকুর কামড়ালে যদি রক্ত বের হয়, কামড়ে দাত বসিয়ে দেয় এমনকি মাংশ নিয়ে যায় তবে ক্যাটাগরি -৩। অথবা ক্যাটাগরি -২ যদি মাথা,গলা, বুক,কাধে হয় তবে সেটিও ক্যাটগরি -৩ এর অন্তভুক্ত হবে। ক্যাটাগরি -৩ হলে

    ১) প্রথমে আক্রান্ত স্থান ক্ষার যুক্ত সাবান দিয়ে কমপক্ষে ১৫ মি ধুইতে হবে।

    ২) তারপরে নিয়ম অনুযায়ী ৫ টি টিকা দিতে হবে।

    ৩) ৫ টি ভ্যাক্সিনের সাথে + Human RIG(Rabies IG) দিতে হবে। এটি ক্ষত স্থানের চার পাশে দিতে হয়।

    ৪) টিটেনাস বা ধনুষ্টংকারের টিকা নিতে হবে। যেহেতু বাহিরের কুকুর বিড়াল ময়লা আবর্জনাতে থাকে সেক্ষেত্রে ধনুষ্টংকারের এর টিকা নেয়া উচিত।

    ৫) এছাড়া ক্ষত শুকানোর জন্য এন্টিবায়োটিক নিতে হবে,

    ৬) ব্যাথার জন্যে ব্যাথার ঔষধ নিতে পারেন। প্রয়োজনে রেজিষ্ট্রার্ড কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে ।

    রেবিস বা জলাতঙ্কের লক্ষণঃ

    সাধারণত রেবিস ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৩ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যে রেবিস বা জলাতঙ্কের প্রথম লক্ষণগুলো দেখা দেয়৷ তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ১ সপ্তাহ থেকে ১ বছর পরেও লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এটি নির্ভর করে কোথায় কামড় দিয়েছে, কতটা ক্ষত হয়েছে তার উপর। তবে ৮১% বেলায় ২০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যেই জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এবং জলাতঙ্কে আক্রান্ত ৭০% রোগি কুকুর কামড়ের দিন থেকে শুরু করে ৫৯ দিনের ভিতর মারা যায়।

    প্রথমতঃ ৭-১০ দিনের মধ্যে – সাধারণ জ্বরের মত, পা ম্যাজ ম্যাজ করা, ক্ষত স্থানের চার পাশে খোচানু ব্যাথা অনুভব করা বা জ্বালাপোড়া করা।

     রেবিস বা জলাতঙ্কের প্রকারভেদঃ

    সাধারনত দুই ধরনের রেবিস দেখা যায়।

    ১) Farious Rabies বা উগ্র জলাতঙ্কঃ এধরনের জলাতঙ্ক রোগীরা Hyperactivity, উত্মেজনাপূর্ন আচরন, কনফিউশান বা দ্বিধাদ্বন্দে ভোগা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এছাড়া রোগী আলো দেখলে ভয় পায় । এরপরই দেখা দেয় মারাত্মক লক্ষণ যার নাম জ্বল + আতঙ্ক = জলাতঙ্ক অথাৎ রোগী পানি দেখলে ভয় পায়। পানি খেতে পারে না। আসলে রোগীর মাংস পেশী সংকোচেনর কারনে পানি বা খাবার খেতে পারে না। বাতাস দেখলে ভয় পান। এর পর রোগী মারা যায়।

    ২) paralytic rabies: এর ধরনের রেবিসে আক্রান্তের সংখ্যা ২০%। এধরনের রেবিসে আক্রান্ত ক্ষতস্থানের চারপাশ অবস হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।

    পরিক্ষা করে কি বুঝা যাবেবে রেবিসে আক্রান্ত কিনা?

    উত্তর হচ্ছে না। এখনো কোন পরিক্ষা আবিষ্কার হয়নি যা দেখে বুঝা যাবে রেবিস আক্রান্ত হবে কিনা। সাধারনত লক্ষণ দেখে, পানি ও বাতাসের প্রতি ভয় দেখেই রোগ নির্ণয় করা হয়।

    কুকুর বিড়াল কামড় দিলে যা যা করা যাবে নাঃ

    ক) কুকুর কামড়ালে ক্ষতস্থানে কোন ভাবেই সেলাই দেয়া যাবে না, কারন ক্ষতস্থানে ধনুস্টংকারে জীবানু থাকতে পারে।আর ক্ষতস্থানে বাতাস পেলে ধনুস্টাংকার বা টিটেনাস জীবানু মারা যায়। শুধু অতিরিক্ত রক্তপাত হলে সেটি বন্ধের ব্যবস্থা নিবেন- সেকেন্ডারি ক্লোজার হিসাবে ।

    খ) কুকুর কামড়ালে ক্ষতস্থানে কোন এন্টিবায়োটিক বা কোন ক্রীম মলম ব্যাবহার করা যাবে না।

    গ) কুকুর কামড়ালে কোন ওজা, কবিরাজ, থেকে যার ফু নেয়া যাবে না।

    ঘ) রেবিস আক্রান্ত ব্যাক্তির অবশিষ্ট খাবার খাওয়া উচিত নয়।

    কুকুর কামড়ালে রোগীর পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়?

    কেউ কেউ মনে করেন পাগলা কুকুরে কামড়ালে রোগীর পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়ে যায় যা মোটেই ঠিক নয়। এটি একধরেন মানসিক রোগ যায় নাম Puppy Pregnancy Syndrome. এটি সাধারনত রোগীর মনের চিন্তা। রোগী মনে করেন যে কুকুরের বাচ্চা পাকস্থলিতে বড় হচ্ছে বিশেষ করে পুরুষ রোগীরা। তারা মনে করে মনে করে পুরুষাঙ্গ দিয়ে কুকুরের বাচ্চা হয়। এটি একদম ভুল ধারনা, কুসংস্কার।

    টিকা নেয়ার পর কত দিন কার্যাকারিতা থাকে?

    সাধারনত ৫ টি টিকা সময় মতো নিলে ২-৩ বছর এর কার্যকারিতা থাকে

    প্রেগন্যান্ট মহিলাকেও কি টিকা দেয়া যাবে?

    উত্তর: হ্যা গর্ভবতী মহিলাকেও জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেয়া যাবে।

    একটা টিকা মিস হলে কি করনীয়?

    একটা টিকা সময় মত না নিতে পারলে ২-৩ আগে পরে হলে সমস্যা নেই। তবে পরবর্তী ডেসা সময় অনুযায়ী দিতে হবে।

    আমি পাচটা টিকা নিয়েছি আবার কুকুরে কামড় দিছে কি করনীয়?

    টিকা দেয়ার পরে ৩ মাসের মধ্যে কুকুর কামড়ালে নতুন করে কোন টিকা নিতে হবে না। তবে টিকা নেয়ার পরে ২ বছরের কম হলে একটি বুস্টা ডোস নিতে হবে। আর ২ বছরের বেশি হলে পূনরায় ৫ টি নিতে হবে।

    কুকুর কামড়ানোর পরে কখন টিকা নেয়া উচিত?

    পশু কামড়ানোর পরপরই টিকা নেওয়া উচিত এবং তা ৫ দিনের মধ্যে নিলে সবচেয়ে ভাল । যেত তাড়াতাড়ি নিতে পারেন ততই ভালো।

    বাচ্চা কুকুড় বা বিড়াল কামড় দিলে কি টিকা নিতে হবে?

     উত্তর হ্যা। বাচ্চা কুকুর বিড়াল কামড় দিলেও টিকা নিতে হবে।

    https://youtu.be/_KhilYHd8Zg?si=yv1B_2fX3zdUdnzH

    উপদেশঃ

    যারা বাড়িতে কুকুর বিড়াল পোষছেন তারা অবশ্যই অবশ্যই পোষা প্রানীকে রেবিস ভ্যাক্সিন দিয়ে নিতে হবে। এছাড়া কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। একবার রেবিস আক্রান্ত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। তাই আক্রান্ত হওয়র আগেই সচেতন হতে হবে।

    আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ

     

    Leave a Comment

    Your email address will not be published. Required fields are marked *