সহবাসের উপযুক্ত সময় মিলন করলে গর্ভধারণের সম্ভবনা থাকে সবচেয়ে বেশি। প্রতিমাসে মাসিকের একটা নির্দষ্ট সময়ে মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে বাচ্চা হওয়ার জন্যে একটি ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়।ডিম্বানু বের হওয়ার সময়টাই হচ্ছে গর্ভধারনের জন্যে সহবাসের উপযুক্ত সময়। কেউ যদি বাচ্চা নিতে চান তাহলে অবশ্যই ডিম্বাণু বের হওয়ার সময়টাতে মিলন করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সহবাসের উপযুক্ত সময় অনুযায়ী সহবাস করতে পারেন না। এছাড়া, বর্তামনে জব, ক্যারিয়ার ইত্যাদির কারনে স্বামী-স্ত্রী দুজনে একসাথে থাকা হয় না।ফলে প্রেগন্যান্সি কনসিভ করতে সমস্যা হয়। তো আজকে আমরা জানবো, কিভাবে আপনি গর্ভধারনের উপযুক্ত সময়ে মিলন করে বের দ্রুত গর্ভধারন করবেন।
মাসিকের পর কখন সহবাসের উপযুক্ত সময়?
গর্ভধারনের জন্যে মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হয়, ডিম্বানু বের হওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ওভুলেশন বা Fertile window. এই ওভুলেশনের সময় হিসবে করে মিলন করলে গর্ভধারনের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। যাকে গর্ভধারনের উপযুক্ত সময় হিসেবে গন্য করা হয়। গর্ভধারনের জন্য সহবাসের উপযুক্ত সময় বের করার জন্যে আপনাকে কতগুলো পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। যেমন
১) সঠিক দিন গননাঃ
প্রত্যেক নারীদের মাসিক চক্র যেমন আলাদা তেমনি প্রত্যেকের ওভুলেশনের সময় ও আলাদা হয়ে থাকে। মাসিক চক্র অনুসারে ওভুলেশন ডে গণনা করতে হবে।ওভুলেশনের ডে গণনা করার সূত্র হলো Menstrual cycle – 14. অর্থাৎ মাসিক চক্র বের করে সেখান থেকে ১৪ দিন বিয়োগ করলে ওভুলেশন ডে বের হয়ে যাবে।
কিভাবে গননা করবেন?
প্রথমে আপনি একটি ক্যালেন্ডার নির্বাচন করুন, তারপর যেদিন আপনার মাসিক শুরু হয়েছে সেই দিনটি চিহ্নিত করুন। মনে করি আপনার ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে । তারপর আপনার মাসিক কতদিন পর পর হয় বা আপনার মাসিক সাইকেল কতদিনের তা থেকে ১৪ দিন বিয়োগ করুন। উদাহারন দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছি।
উদাহরণ-১ঃ ধরুন আপনার মাসিক চক্র হিসেব করে দেখলেন আপনার ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়। তাহলে আপনার ভুলেশন বা ডিম্বপাতের সময় হলো ২৮-১৪ = ১৪। তাহলে আপনার মাসিকের ১৪তম দিন টি হলো আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়।এই ১৪ তম দিন হিসেব করতে হবে মাসিক শুরুর দিন থেকে। অথার্ৎ ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে তাহলে আপনার ১৪ তারিখ হচ্ছে মাসিকের ১৪ তম দিন। এখন এই ১৪ তম দিনের সাথে ৩ দিন আগে পরে যোগ-বিয়োগ করে নিন। ১৪ তম দিনের সাথে ৩ দিন যোগ-বিয়োগ করলে হয় ১১ থেকে ১৭তম দিন। সুতরাং আপনার যদি প্রতিমাসে ২৮ দিন পরপর মাসিক হয় তাহলে মাসিকের ১১-১৭ তম দিন হচ্ছে আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময় বা গর্ভধারনের জন্য সহবাসের উপযুক্ত সময়।
এখন অনেকেই ভাবতে পারেন ১৪ তম দিনের সাথে ৩ দিন আগে ও পরে যোগ-বিয়োগ করার উদ্দেশ্য কি?
অনেক সময় দেখা যায় মাসিক ২-৩ দিন আগে হয়ে যায় আবার কখনো ২-৩ দিন পরেও হয়ে থাকে। মাসিক আগে পরে হলে ওভুলেশন ২-৩ দিন আগে বা পরে হতে পারে। সেজন্যে ওভুলেশন ডে বা Fertile window কে একটু বেশি করে নেয়া হয়, যেন কোন ভাবেই ওভুলেশন ডে মিস না হয়। ওভুলেশনের সঠিক দিন গণনা করার জন্যে অবশ্যই আপনার পিরিয়ড নিয়মিত হতে হবে এবং আপানাকে আপনার মাসিকচক্র বা Menstrual cycle গণনা জানতে হবে। (মাসিকচক্র বা Menstrual cycle গণনা পদ্ধতি নিয়ে জানতে চাইলে পড়ুন)
২) সাদা স্রাব (Cervical Mucus) ঘনত্ব পর্যবেক্ষণঃ
মাসিক চক্রের বিভিন্ন সময় হরমোনের তারতম্যের কারনে মেয়েদের যোনি পথে কিছু স্রাব নিঃসৃত হয়।এই স্রাব কখনো ঘন আঠালো কখনো পাতলা, কখনো কম কখনো বেশি হয়ে থাকে। ওভুলেশনের ১-২ দিন আগ থেকে মেয়েদের যোনি পথে এক ধরনের স্রাব নিঃসৃত হয়। যা দেখতে পাতলা, স্বচ্ছ, আঠালো অনেকটা ডিমের সাদা অংশের মত যাকে cervical mucus বলে। এই স্রাব হাতে নিলে কয়েক ইঞ্চিপর্যন্ত লম্বা হয়। এই স্রাব গন্ধ ও রঙহীন হবে।এরকম স্রাব ওভুলেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।বিশেষ করে যাদের পিরিয়ড অনিয়মিত তাদের জন্যে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে এমন সাদা স্রাব দেখে মিলন করা। এরকম স্রাব যেদিন দেখবেন, সেদিন থেকে সহবাস শুরু করবেন এবং যেদিন পাতলা স্রাব যাওয় বন্ধ হবে তার ৩ দিন পর পর্যন্ত মিলন করবেন।
যোনিতে এমন পাতলা স্রাব দেখে মিলন করলে গর্ভধারনের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
৩) শরীরের তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করে মিলন করাঃ
মানব দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা হচ্ছে ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাই।ওভুলেশন সময় বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা তারতম্য হয়। ফলে ওভুলেশনের মেয়েদের শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে।মোটমোটি ০.২ থেকে ০.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যা পরিমাপ না করলে বুঝা সম্ভব নয়। মাসিক বন্ধ হওয়ার পর থেকে তাপমাত্রা পরিমাপ শুরু করে একটা চার্ট তৈরি করুন। যেদিন থেকে তাপমাত্রা বেশি দেখবেন সেদিন থেকে সহবাস শুরুর করবেন।ওভুলেশনের সময় তাপমাত্রা পর পর তিন দিন বেশি থাকে। তিন দিন তাপমাত্রা বেশি থাকার পরে ওভুলেশনের সময় শেষ হয়ে যায়। এই ভাবে তাপমাত্রা পরিমাপ করে সহবাসের উপযুক্ত সময়কে কাজে লাগানো সম্ভব।
কিভাবে তাপমাত্রা পরিমাপ করবেন?
ক) আপনাকে অবশ্যই তাপমাত্রা পরিমাপের জন্যে একটি ডিজিটাল থার্মোমিটার নির্বাচন করতে হবে।যেকোন ফার্মেসীতে ১৫০-২০০ টাকায় ডিজিটাল থার্মোমিটার পেয়ে যাবেন।
খ) সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করার আগেই তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে।
গ) অবশ্যই মুখে (জিহ্বার নিচে) তাপমাত্রা পরিমাপ করতে হবে)
৪) ওভুলেশন টেস্ট কিট ব্যবহারঃ
ওভুলেশনের ২-৩ দিন আগ থেকে মেয়েদের শরীরে LH (Luteinizing Hormone) বৃদ্ধি পায়। তখন পস্রাবে luteinizing hormone এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। তখন ওভুলেশন টেস্ট ব্যবহার করেও সহবাসের উপযুক্ত সময় বা ওভুলেশন ডে সনাক্ত করা যায়।
কিভাবে ওভুলেশন টেস্ট কিট ব্যবহার করবেন?
সাধারণত ওভুলেশন টেস্ট কিট pregnancy সনাক্ত কারী টেস্ট কিটের মতোই। মাসিক চক্র হিসেব করে যেদিন আপনার Fertile window শুরু হবে, সেদিন থেকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, সকাল বেলার প্রথম পস্রাব দিয়ে টেস্ট করবেন।টেস্ট পজেটিভ আসলে বুঝবেন ২৪-২৪ ঘন্টার মধ্যে আপনার ওভুলেশন হবে। সেই অনুযায়ী মিলন করলে গর্ভধারনের সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
ওভুলেশনের সময় কিভাবে মিলন করবেন?
মেয়েদের ওভুলেশন বা ডিম্বাণু বের হওয়ার পরে, ডিম্বানু ২৪ ঘন্টা জরায়ুতে অবস্থান করে এবং মিলনের পরে ছেলেদের শুক্রানু মেয়েদের যৌনিতে ৫ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে। বাচ্চা হওয়ার জন্যে সুস্থ্য শুক্রানুর দরকার। অনেক গবেষণায় দেখা গিয়েছে প্রতিদিন মিলনের চেয়ে ১ দিন পর পর মিলনকরলে শুক্রানুর গুনাগুন ভাল থাকে। যেহেতু শুক্রানু মেয়ের যোনিতে ৫ দিন পর্যন্ত বেচে থাকে এবং ওভুলেশনের পর ডিম্বানু ২৪ ঘন্টা অবস্থান করে,তাই একদিন পর পর মিলন করলে যখন ডিম বের হোক না কেন আপনার বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু থাকবে ইনশাআল্লাহ।
ওভুলেশনের সময় কি সকলেই এসব লক্ষণ থাকে?
উত্তর হচ্ছে না।ওভুলেশন হলে সবার এসব লক্ষণ নাও থাকতে পারে। অনেকের ১-২ টা লক্ষণ থাকতে পারে। কেউ কেউ আবার কখন ওভুলেশন হয় বুঝতেই পারেন না। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে একটা লক্ষণের উপর নির্ভর না করে সবগুলো পদ্ধিতের সমন্বয় করে ওভুলেশন ডে অনুসন্ধান করা। প্রত্যেক নারীরে মাসিক চক্র যেমন আলাদা তেমিন ওভুলেশন ডে এবং এর লক্ষণ গুলো আলাদা হয়ে থাকে।কোন পদ্ধতি ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হওয়ার সঠিক সময় ১০০% নিশ্চিত করতে পারে না।তবে এই বিষয় গুলো অনুসরণ করে সহবাসের উপযুক্ত সময় মিলন গর্ভধারনের সম্ভবনা বৃদ্ধি পাবে (ইনশাআল্লাহ)
বাচ্চা না হলে কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকেন, সপ্তাহে ২-৩ বার মিলন করেন, এ ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ ভাগ দম্পতি ১ বছরের মধ্যে গর্ভধারন করেন।স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকেন, সপ্তাহে ২-৩ বার মিলন করেন এভাবে ১ বছর চেষ্টা করার পরেও যদি গর্ভধারন না তাহলে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী দুজনইকেই একজন Infertility specialist এর নিটক যেতে হবে।অথবা নারীর বয়স যদি ৩০ এর বেশি হয় এবং এভাবে ৬ মাস চেষ্টা করার পরেও গর্ভধারন না হয় তাহলে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই একজন Infertility specialist এর পরামর্শ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ২-৩ মাস চেষ্টা করার পরে গর্ভধারন না হলে দুঃচিন্তাগ্রস্থ হয়ে যায়। এতে ভয়ন কারন নেই। সময় নিন ওভুলেশন ডে অনুযায়ী মিলন করুন।
আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ