মাসিক চক্র গণনা বা ঋতুচক্র গণনা সর্ম্পকে প্রত্যেকটা নারীর জানা দরকার। আপনি যদি বাচ্চা নেয়ার উপযুক্ত সময় গণনা করতে চান অথবা ঔষধ ছাড়া কিংবা কোন প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ছাড়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে চান। তাহলে অবশ্যই আপনাকে মাসিক চক্র গণনা সম্পর্কে জানতে হবে। মাসিক চক্র গণনা মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন মাসিক নিয়মিতভাবে হচ্ছে নাকি অনিয়মিত। এবং কখন ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফোটনের উপযুক্ত সময়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র গণনা করতে গিয়ে ভুল করেন, অনেক সময় নানান কনফিউশানে ভুগেন। তো আজকে আমরা জানবো কিভাবে মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র গণনা করতে হয়।
মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র কি?
একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মেয়েদের মাসিক হয়। মাসিক শুরুদিন থেকে পরের মাসে মাসিক শুরুর আগের দিন পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টাকে বলা হয় ঋতুচক্র বা মাসিক চক্র। অর্থাৎ একটা মাসিক শুরু থেকে আরেকটি মাসিক শুরু মধ্যে যে গ্যাপ সেটিই হচ্ছে মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র । মাসিক চক্র বা ঋতুচক্রকে মেডিক্যালের ভাষায় বলা হয় Menstrual cycle.
স্বাভাবিক মাসিক বা ঋতুচক্র
প্রথমেই স্বাভাবিক Menstrual cycle সম্পর্কে একটু জানা যাক। স্বাভাবিক মাসিক চক্র হচ্ছে ২২-৩৮ দিন। তবে প্রত্যেক নারীর মাসিক চক্র আলাদা আলাদা হতে পারে। সাধারণত সর্বনিম্ন ২২ দিন পর পর এবং সবোর্চ্চ ৩৮ দিন পর পর মাসিক হতে পারে। অর্থাৎ কারো কারো ২২ দিন পর পর মাসিক হতে পারে আবার কারো ৩৮ দিন পর পর মাসিক হতে পারে ।এক্ষেত্রে উভয়ই স্বাভাবিক মাসিক চক্র হিসেবে গন্য হবে।
কিভাবে মাসিক চক্র গণনা করবেন?
কিভাবে মাসিক চক্র গণনা করতে হয় মাসিকের শুরু দিন থেকে পরবর্তী মাসিক শুরুর আগের দিন পর্যন্ত। চলুন ২ টি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া যাক।
উদাহরণ-১ঃ
মনে করি একটি মেয়ে যার নাম টিনা। এখন ধরুন,
- টিনার প্রথম মাসিক শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে এবং পরবর্তী মাসিক অথাৎ
- ২য় মাসিক শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ। এখানে লক্ষ্য করুন তার ২য় মাসিক শুরু হওয়ার আগের দিনটি হচ্ছে ২৮ জানুয়ারি। তার মানে এই ২৮ জানুয়ারী হচ্ছে প্রথম মাসিকের শেষ দিন । যেহেতু ২৯ তারিখে ২য় মাসিক শুরু হয়েছে তাই ২৯ তারিখ এখানে আসবে না। এখানে বুঝা গেলো যে টিনার প্রথম মাসিকের চক্রটি জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে শুরু হয়ে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ছিলো। এখন ১ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত গণনা করলে হয় ২৮ দিন। তাহলে টিনার প্রথম মাসের মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ২৮ দিন। টিনার ২য় মাসিক শুরু হয়েছিলো ২৯ জানুয়ারি।
- মনে করি ৩য় মাসিক শুরু হয়েছে ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ। তাহলে তার ২য় মাসিকের শেষের দিন হলো ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি। এখন ২য় মাসিকের শুরুর দিন ২৯ জানুয়ারি থেকে ২য় মাসিক শেষের দিন ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি গণনা করলে হয় ২৮ দিন। তাহলে বুঝা গেলো টিনার ২য় মাসের মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ও ২৮ দিন। টিনার ৩য় মাসিক শুরু হয়েছিলো ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি।
- মনে করি টিনার ৪র্থ মাসিক শুরু হয়েছে ২৬ মার্চ, তাহলে তার ৩য় মাসিকের শেষের দিন হলো ২৫ মার্চ। এখন ৩য় মাসিকের শুরুর দিন ২৬ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ৩য় মাসিক শেষের দিন ২৫ মার্চ যা গণনা করলে হয় ২৮ দিন। তাহলে বুঝা গেলো টিনার ৩য় মাসের মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ও ২৮ দিন। এখানে লক্ষ্য করুন টিনার তিন মাসের মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ২৮ দিন অর্থাৎ একটা মাসিক শুরু থেকে আরেকটা মাসিক শুরু হওয়ার মধ্যে যে সময় তা সব সময় একই। তার মানে টিনার Menstrual cycle বা পিরিয়ড টি কিন্তু স্বাভাবিক।
বিঃদ্রঃ তবে কখনো কখনো ২-৩ দিন আগে বা পারেও হতে পারে যেমন কখনো ২৬ দিন পরে হতে পারে আবার কখনো ৩০ দিন পরে হতে পারে এক্ষেত্রেও কিন্তু পিরিয়ড স্বাভাবিক বা আপনার মাসিক চক্রটি ২৮ দিনের বলতে পারেন। এভাবে গণনা করার পরে যদি দেখেন আপনার মাসিক চক্রের সময়কাল ২২- ৩৮ দিনের মধ্যে আছে তাহলে এটি স্বাভাবিক মাসিক চক্র বলা যায়। তবে প্রতিমাসে একই সময় কাল হতে হবে এক মাসে এক এক রকম হওয়া যাবে না। আরেকটি উদাহরণ দিলে সহজেই বুঝতে পারবেন।
উদাহরণ-২ঃ
মনে করুন আরেকটি মেয়ে যার নাম মিনা, মিনারও প্রথম মাসিক শুরু হয়েছিলো জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ এবং ২য় মাসিক শুরু হয়েছিলো জানুয়ারির ২৯ তারিখ। সুতরাং মিনার প্রথম মাসিকের শেষ দিন ২৮ জানুয়ারি। সেই হিসবে মিনার প্রথম মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ২৮ দিন। মিনার ২য় মাসিক শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি এখন ধরুন মিনার ৩য় মাসিক শুরু হয়েছে মার্চ মাসের ৪ তারিখ তাহলে তার ২য় মাসিকের শেষের দিন হবে মার্চ মাসের ৩ তারিখ। এখন ২৯ জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত গণনা করলে হয় ৩৫ দিন। তার মানে মিনার ২য় মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ৩৫ দিন।
আবার মিনার ৩য় মাসিক শুরু হয়েছিলো ৪র্থ মার্চ। ধরুন তার ৪র্থ মাসিক শুরু হয়েছে ২৬ মার্চ। তাহলে তার ৩য় মাসিক চক্রের শেষ দিন ২৫ মার্চ। সেই হিসেবে মিনার ৩য় মাসিক চক্রের ব্যাপ্তিকাল ২২ দিন।
- লক্ষ্য করুন মিনার প্রথম মাসে ২৮ দিন পর মাসিক হয়েছে
- তার পরের মাসে ৩৫ দিন পর মাসিক হয়েছে
- এবং তার পরের মাসে ২২ দিন পরে মাসিক হয়েছে। সুতরাং মিনার একটা মাসিক শুরু থেকে আরেকটা মাসিক শুরু হওয়ার সময়টা নির্দিষ্ট না, তাই মিনার পিরিয়ড টি অনিয়ম হিবেসে গন্য হবে। অথাৎ মিনার মাসিক চক্র এক এক মাসে এক এক রকম হচ্ছে।
কারো মাসিক চক্র যদি ২২ দিনের হয় তাহলে তার প্রতি মাসে ২২ দিন পরপর মাসিক হতে হবে। কারো যদি মাসিক চক্র ৩০ দিনের হয় তাহলে তার ৩০ দিন পর পর ই মাসিক হতে হবে। কারো যদি ৩৫ দিন পর পর মাসিক হয় তাহলে ৩৫ দিন পর পরই মাসিক হতে হবে। মাসিক চক্র সর্বোচ্চ ২-৩ দিন আগে পরে হতে পারে এর বেশি নয়। কোন মাসে ২২ দিন, কোন মাসে ৪০ দিন কোন মাসে ১৫ দিন এভাবে মাসিক হলে বুঝতে হবে আপনার পিরিয়ড অনিয়মিত।
মাসিক চক্র গণনায় করনীয়
মাসিক চক্র গণনা করার জন্যে প্রথমে একটি ক্যালেন্ডার নির্বাচন করুন, তারপর যে তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে সেই তারিখটি চিহ্নিত করুন। তার পরের মাসে কবে মাসিক শুরু হয় সেটি চিহ্নিত করুন । এখন মাঝের দিন গুলো গণনা করুন এভাবে পর পর তিনটি মাসিক চক্র গণনা করুন। তাহলেই সঠিকভাবে আপনি আপনার মাসিক চক্র গণনার পাশাপাশি সেটি নিয়মিত নাকি অনিয়মিত সহজেই বুঝতে পারবেন (ইন-শা-আল্লাহ)। আর যদি মাসিক চক্র অনিয়মিত হয় তাহলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কিভাবে বুঝবেন মাসিক বা ঋতুচক্র অনিয়মিত
প্রতিমাসে যদি নির্দিষ্ট সময়ে মাসিক না হয়, অথবা মাসিকের সময় ৩ দিনের কম বা ১০ দিনের বেশি রক্তক্ষণ হয় তখন তাকে অনিয়মিত মাসিক বলা হয়। যে বিষয় গুলো দেখলে বুঝবেন আপনার পিরিয়ড অনিয়মিত, যেমন
- মাসিক যদি ২১ দিন কম কিংবা ৩৮ দিনের বেশি ব্যবধানে হয়।
- ৯০ দিনের মধ্যে মাসিক না হলে।
- মাসিকের সময় ১০ দিনের বেশি রক্তক্ষরণ হলে।
- মাসিকের সময় ৩ দিনের কম রক্তক্ষরণ হলে।
- দুইটা মাসিকের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তপাত হলে।
এই লক্ষণ গুলো থাকলে বুঝতে হবে আপনার মাসিক অনিয়মিত। অনিয়মিত মাসিক হলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মাসিক অনিয়মিত হলে কি বাচ্চা হয়?
কারো মাসিক অনিয়মিত এর মানেরই হলো তার প্রজনন তন্ত্রের কোথাও না কোথাও সমস্যা রয়েছে। এছাড়া মাসিক অনিয়মিত হলে ওভুলেশন স্বাভাবিক ভাবে হয় না। ফলে মাসিক অনিয়মিত হলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হয়। তবে সঠিক চিকিৎসা নিয়ে মাসিক নিয়মিত হলে বাচ্চা নিতে পারবে (ইন-শা-আল্লাহ)। অধিকাংশ নারীরাই চিকিৎসা নেয়ার পরে গর্ভধারণ করে থাকেন।
আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ