নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক সর্ম্পকে প্রত্যেকটা নারীর ধারনা থাকা অত্যান্ত জরুরী। বয়ঃসন্ধি কাল থেকে শুরু করে মোটামোটি মেনোপজ (Menopause) পর্যন্ত প্রত্যেক মাসেই মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব হয়ে থাকে। শুধু মাত্র গর্ভধারণ করলে কিংবা বাচ্চা বুকের দুধ প্রাণ করালে সাময়িক সময়ের জন্য মাসিক বন্ধ থাকে। মাসিক শুরু মাধ্যমে একজন নারী তার জীবনের পূর্নতা লাভ করে। একজন নারীর মাসিক যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে ধরে নেয়া যায় তার প্রজনন স্বাস্থ্য স্বাভাবিক আছে। কিন্তু অধিকাংশ নারী তার মাসিক স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক সেটি বুঝতেই পারেন না। তো আজকে আমরা নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক বা ঋতুস্রাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
মাসিক বা ঋতুস্রাব কি? কেন হয়?
ইংরেজিতে Menstruation যার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে মাসিক বা ঋতুস্রাব। মেয়েদের প্রজনন তন্ত্রের একটি অঙ্গ হচ্ছে জরায়ু। জরায়ুর ভেতরের অংশ বা দেয়ালের নাম হচ্ছে এন্ডোমেট্রিয়াম। প্রতিমাসে বিভিন্ন হরমোনের তারতম্যের প্রভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর জরায়ুর ভেতরের অংশ এন্ডোমেট্রিয়াম এর কোষ গুলো পচে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয় এবং যোনিপথ দিয়ে বের হয়। যোনিপথ দিয়ে রক্তক্ষরণের এই প্রক্রিয়াকে সাধারনত মাসিক বা ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড বলা হয়। এন্ডোমেট্রিয়াম এর এই রক্তক্ষরণ যোনিপথে কয়েক দিন ধরে চলতে থাকে।
কখন মেয়েদের মাসিক শুরু হয়?
সাধারনত মেয়েদের ১০-১৪ বছর বয়সের মধ্যে তার প্রথম মাসিক শুরু হয়। প্রথম মাসিক হওয়াকে মেডিক্যালের ভাষায় “Menarche” বলা হয়। মেয়েদের মাসিক ১০-১৪ বছর বয়সের শুরু হয়ে মোটামোটি ৫০-৫৫ বছর বয়সে বন্ধ হয়ে যায়। মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়টাকে মেডিক্যালের ভাষায় মেনোপজ বলে। তবে বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক কারনে নারীর মাসিক শুরু এবং শেষ হওয়ার সময় কিছুটা কম বেশি হতে পারে।
মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র কি?
প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মেয়েদের মাসিক হয়। এক মাসে মাসিক শুরুদিন থেকে পরের মাসে মাসিক শুরুর দিন পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টাকে বলা হয় Menstrual cycle বা মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র । অর্থাৎ একটা মাসিক শুরু থেকে আরেকটি মাসিক শুরু মধ্যে যে গ্যাপ সেটিই হচ্ছে মাসিক চক্র বা ঋতুচক্র ।
কত দিন পর পর মাসিক হওয়া স্বাভাবিক?
একজন নারীর কত দিন পরপর মাসিক হবে এটি নির্ভর করে তার Menstrual cycle বা মাসিক চক্র কতদিনের তার উপর। সাধারণত একজন নারীর ২৮ দিনের মাসিক চক্র বা ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়ে থাকে। তবে কারো কারো ২২ দিন পর পর মাসিক হতে পারে। কারো কারো ৩৮ দিন দিন পর পর মাসিক হতে পারে। স্বাভাবিক মাসিক চক্র হচ্ছে ২২ থেকে ৩৮ দিন। আপনার মাসিক চক্র কত দিনের সেটা জানতে আপনার মাসিক চক্র গণনা করে করে বের করতে হবে। কারন নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক অনেকটাই Menstrual cycle বা মাসিক চক্রের উপর নির্ভর করে।
মাসিকের সময় কতদিন রক্তক্ষণ হওয়া স্বাভাবিক?
মাসিকের সময় সাধারনত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। গড় হিসেবে ৫ দিন। যদি কোন কারনে মাসিকের সময় ৩ দিনের কম, অথবা ৭ দিনের বেশি রক্তক্ষণ হয় তাহলে তাকে অনিয়মিত মাসিক বা অনিয়মিত পিরিয়ড বলে। অনিয়মিত মাসিক হলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাহলে নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক এর সময় কতদিন রক্তক্ষণ হবে সেটা আমরা বুঝতে পারলাম।
নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক এর সময় কতটুকু রক্তক্ষরণ হয়?
মাসিকের রক্তে সাধারণত রক্তকোষ ও বিভিন্ন তরল পদার্থ থাকে। মাসিকরে সময় রক্তক্ষণ ৩-৭ দিন স্থায়ী হয়। প্রত্যেকবার মাসিকের সময় প্রায় ৪০ মিলি লিটার রক্ত এবং ৩৫ মিলি লিটার বিভিন্ন তরল পদার্থ নিঃসৃত হতে পারে । সেই হিসেবে প্রত্যেকবার মাসিকের সময় মোটামোটি ৩০- ৮০ মিলি লিটার রক্তক্ষরণ হওয়া স্বাভাবিক। চা চামচের পরিমাপে ৬-১৬ চামচ। মাসিক যদি ২ দিনের কম এবং ৩০ মিলি এর কম হয় তাকে বলে Hypomenorrhea. Hypomenorrhea এর মানে হচ্ছে মাসিকের সময় কম রক্তক্ষরণ হওয়া।
অন্যদিকে যদি মাসিক ৭ দিনের বেশি হয় এবং ব্লাডের পরিমান যদি ৮০ মিলি লিটারের বেশি হয় সেটাকে Polymenorrhoea বলে। Polymenorrhoea এর মানে হচ্ছে মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। তো আশা করি মাসিকের সময় কতটুকু রক্তক্ষণ হচ্ছে সটি দেখে নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক সর্ম্পকে বুঝতে পারবেন (ইন-শা-আল্লাহ)।
কিভাবে বুঝবেন মাসিকরে সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে?
মাসিকের সময় মোটামোট চারটি বিষয় লক্ষনীয় হলে বুঝবেন আপনার মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষণ হচ্ছে। যেমন,
- যদি দেখা যায় প্রতি ২ ঘন্টার মধ্যে আপনার ব্যবহৃত সেনিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন পরিবর্তন করতে হয় ।
- যদি রক্তক্ষণ স্বাভাবিক কিন্তু ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হয়।
- যদি ১ ইঞ্চি বা কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সমান জমাট বাধা বা রক্তের চাকা যায়।
- যদি রাতে ঘুমানোর সময় সেনিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন ভিজে গিয়ে কাপরে লেগে যায় বা একসাথে ২ টি সেনিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হয়।তাহলে বুঝতে হবে সেটি অতিরিক্ত রক্তক্ষণ হচ্ছে। মাসিকের সময় কম রক্তক্ষণ বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মাসিকের রক্ত দেখতে কেমন হবে?
মাসিকের রক্ত সাধারনত স্বাভাবিক রক্তের চেয়ে কিছুটা কালচে হয়ে থাকে। তবে এর রং উজ্জ্বল লাল থেকে কালচে লাল রঙের হয়ে থাকে। এছাড়া রক্তের পরিমাণ কম হলে কালচে দেখায়, বিশেষ করে যখন মাসিকের রক্ত জমাট বেধে যায়। অর্থাৎ মাসিকের রক্ত উজ্জ্বল লাল থেকে কালচে লাল রঙের এমনকি ব্রাউন কালার হতে পারে।
মাসিকের সময় রক্তস্রাব কেন হয়?
মাসিকের সময় জরায়ুর ভেতরের অংশ এন্ডোমেট্রিয়াম অনেক পাতলা হয়ে যায়। এই সময় জরায়ুতে ইনফেকশনের চান্স থাকে সবচেয়ে বেশি। তখন আমাদের শরীর থেকে Leukocyte নামক এক ধরনের কোষ নিঃসৃত করে, সেজন্য মাসিকের সময় অনেকের সাদা পিচ্ছিল পর্দাথ যেতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই। অনেক সময় সাদা স্রাবের সাথে রক্ত মিশ্রিত হয়ে রক্তস্রাবের সময় দেখা যায় বিশেষ করে যখন কম রক্তক্ষণ হয় তখন রক্তস্রাব দেখা যেতে পারে । নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক উভয় ক্ষেত্রেই রক্তস্রাব হতে পারে।
মাসিকের সময় স্বাভাবিক কিছু লক্ষণঃ
মাসিকের সময় মেয়েদের কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেমন
- মুড পরিবর্তন হওয়া
- দুঃচিন্তা গ্রস্ত হওয়া
- মেজাজ খিটখিটে হতে পারে
- বেশি আবেগ প্রবন হয়ে যায়
- অনেক সময় পেটে ব্যাথা হয়ে থাকে
- বমি ভাব, খাবারে অনিহার পাশপাশি অনেক সময় বমিও হতে পারে।
এগুলো স্বাভাবিক লক্ষণ, তবে যদি অতিরিক্ত সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ।
মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হলে কি করনীয়ঃ
মাসিকের সময় অধিকাংশ মেয়েদেরই পেটে ব্যাথা হয়ে থাকে। বিশেষ করে অবিবাহিত মেয়েদের মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা বেশি হয় । অধিকাংশ মেয়েদেরই বিয়ে বা সন্তান প্রসবের পরে মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা ভালো হয়ে যায়। তবে নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক উভয় ক্ষেত্রেই মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হতে পারে। মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হলে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন। যেমন
- গরম পানির সেক নেয়া। একটি হট ওয়াট ব্যাগে কিংবা প্লাসিকের বোতলে গরম পানি নিন। তারপর একটি সুতি কাপর দিয়ে প্যাচিয়ে পেটে সেক দিতে পারেন। এতে করে ব্যাথা অনেকাংশই কমে যাবে ইনশাআল্লাহ।
- আদা খেতে পারেন। মাসিকের ব্যাথা শুরুর আগে থেকেই কাচা আদা চিবিয়ে কিংবা চায়ের সাথে দিয়ে খেতে পারেন।
- কিছু ব্যায়াম করতে পারেন যেমন বাটারফ্লাই এক্সারসাইজ।
- এর পরেও ব্যাথা উপশম না হলে ব্যাথা নাশক ঔষধ যেমন, প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন, মেফিনেমিক এসিড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে পারেন।
মাসিকের সময় যা করা যাবে না
নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক যেটাই হোক নিম্নক্তো বিষয়গুলো মাসিকের সময় করা যাবে না।
- মাসিকের সময় ৬ ঘন্টার বেশি স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করা যাবে না।
- প্রত্যেকবার স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তনের পরে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তবে কখনো যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার জন্যে কোন সাবান, লোশন বা এন্টিসেপটিক ব্যবহার করা যাবে না। শুরু মাত্র পানি ব্যবহার করবেন।
- মাসিক চলাকানীর সময় সহবাস করা যাবে না।
- মাসি চলাকালীন সময় এসপিরিন জাতীয় ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া যাবে না।
প্রচলিত কুসংস্কার:
- অনেকেই বলে থাকেন মাসিক চলাকালীন সময় মাছ মাংস খাওয়া যাবে না, এটা ঐটা খাওয়া যাবে না। এগুলো একদমই ভুল ধারন। বরং মাসিকের সময় প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত।
- অনেকেই মনে করে থাকেন মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হলে বাচ্চা হয় না অথবা বাচ্চা নিতে সমস্যা হয়। এটিও পুরোপুরি ভুল ধারনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীরা মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা নিয়ে সফলভাবে গর্ভধারণ করেছেন।
- অনেকেই মনে করে থাকেন মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হলে কোন ব্যাথা নাশক ঔষধ নেয়া যাবে না, কারন ব্যাথা নাশক ঔষধ নিলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হয়। এটিও পুরোপুরি মিথ্যা। মাসিকের সময় পেটে ব্যাথা হলে ব্যাথা নাশক ঔষধ নেয়া যাবে, মাসিকের সময় ব্যাথা নাশক ঔষধ নিলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হয় না।
কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?
- যদি আপনার মাসিক অনিয়মিত হয়।
- যদি মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়।
- যদি মাসিকের সময় অতিরিক্ত পেটে ব্যাথা হয়
- যদি মাসিকের সময় অতিরিক্ত জমাট বাধা রক্তক্ষরণ হয়। এই লক্ষ্যণ গুলো দেখা দিলে দ্রুত একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সুতরাং মাসিক বা ঋতুস্রাব কোন রোগ নয়। এটি নারীদের প্রজনন তন্ত্রের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এই সময় নারীদের সাথে আন্তরিকতার সাথে ব্যাবহার করুন। ভালো থাকুক সমাজের প্রতিটি নারী। নিয়মিত ও অনিয়মিত মাসিক সর্ম্পকে সচেতনতার উদ্দেশ্যে জনস্বার্থে সেয়ার করতে পারেন।
আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ