বর্তমানে শতকরা ৮-১৮% নারীরা বিভিন্ন সিস্টের সমস্যার ভোগে থাকেন। এর মধ্যে খুব কমন এক ধরনের সিস্ট হচ্ছে চকলেট সিস্ট। মেয়েদের মাসিকের সময় পেটে ব্যথা, বন্ধ্যাত্বের সমস্যার অনেক গুলো কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে এন্ডোমেট্রিওসিস বা চকলেট সিস্ট । তো আজকে আমরা জানবো, চকলেট সিস্ট কি? কেন হয়? এর লক্ষণ ও চিকিৎসা কি? এবং এই সিস্ট হলে পরবর্তীতে বাচ্চা নিতে কোন সমস্যা হয় কিনা?
চকলেট সিস্ট কি ?
চকলেট সিস্ট বুঝার আগের আমাদেরকে কিছু বেসিক বিষয় বুঝতে হবে।
ছবিটি লক্ষ্য করুন এটি মেয়েদের প্রজনন তন্ত্রের একটি ছবি। জরায়ুর ভেতরের অংশের না এন্ডোমেট্রিয়াম (Endometrium). সাধারণত মাসিকের সময় বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের ফলে এন্ডোমেট্রিয়াম পচে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয় এবং যোনি পথে বের হয় যাকে আমরা মাসিক বলে থাকি। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে এন্ডোমেট্রিয়াম এর কোষ গুলো জরায়ু ছাড়াও, জরায়ুর বাহিরে অংশ যেমন ওভারি, ফেলোফিয়ান টিউব, মূত্রথলী অর্থাৎ পেটের যেকোনো অংশে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। মাসিকের সময় হরমোনের পরিবর্তনের ফলে এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ গুলো জরায়ু এবং জরায়ুর বাহিরে যেখানেই থাকে সবজায়গায় থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়। এই অবস্থাকে এন্ডোমেট্রিওসিস (endometriosis) বলা হয়। কোনো কারণে যদি এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ গুলো মেয়েদের ওভারি বা ডিম্বাশয়ে থাকে তখন মাসিকে হলে ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়।
জরায়ুর ভেতরের রক্ত সাধারণত যোনি পথে বের হতে পারে, কিন্তু ডিম্বাশয়ের ভেতরে রক্তক্ষরণ হলে বের হতে পারে না, ফলে সেখানে রক্ত জমা হয়ে একটা সিস্ট তৈরি হয়। যাকে ovarian endometrioma বলা হয়। এই সিস্টের রঙের অনেকটা চকোলেটের মতো হয় বলেই Ovarian endometrioma কে চকলেট সিস্ট বলা হয়। একদম সহজ ভাষায় বললে, মাসিকের রক্ত ওভারি বা ডিম্বাশয়ে জমা হয়ে যখন সিস্ট তৈরি করে, সেই সিস্টকে চকলেট সিস্ট (chocolate cyst) বলা হয়।
চকলেট সিস্ট কেন হয়?
চকলেট সিস্ট বা ovarian endometrioma মূলত এন্ডোমেট্রিওসিস এর একটা অংশ। এন্ডোমেট্রিওসিস এ আক্রান্ত শতকরা ১৮-৪৪% নারীদের এই সিস্ট হয়ে থাকে। এর সুনির্দিষ্ট কোন কারণ এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানে অজানা। তবে কিছু সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। যেমন
১) Retrograde Menstruation: যখন মাসিক হয় তখন মাসিকের রক্ত যোনি পথে দিয়ে বের হয়ে যায়, কিন্তু মাসিকের রক্ত যদি ডিম্বাশয় বলা অন্য কোথায় চলে যায় তখন তাকে Retrograde menstruation বলে। অর্থাৎ মাসিকের রক্ত উলটো পথে চলে যায়। মাসিকের রক্ত ওভারি বা ডিম্বাশয়ে জমা হয়ে সিস্ট তৈরি করে।
২) এন্ডোমেট্রিয়াল সেল ট্রান্সপ্লান্টেশন: কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে, মাসিকের সময় এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ গুলো রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে পেটের অন্যান্য অংশে পৌঁছে যায় এবং সেখানে বৃদ্ধি পায়। মাসিকের সময় বিভিন্ন হরমোনের পরিবর্তনের ফলে সেই কোষ গুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয় এবং সিস্ট তৈরি হয়।
৩) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: শরীরে রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে মাসিকের সময় রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে যে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষ গুলো পেটের অন্যান্য অংশে পৌঁছে যায় , সেগুলো ধ্বংস করতে পারে না। তখন এধরনের সিস্ট হতে পারে।
৪) বংশগত: এছাড়া কিছু বংশগত কারণে হতে পারে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে ।
চকলেট সিস্টের লক্ষণ
চকলেট সিস্টের লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে, তবে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়:
১) পেটে ব্যথাঃ এর সবচেয়ে কমন লক্ষণ হচ্ছে ব্যথা।
- মাসিকের সময় পেটে ব্যথা হতে পারে,
- সহবাসের সময় ব্যথা হতে পারে,
- প্রস্রাব পায়খানার সময় ব্যথা হতে পারে,
২) বারবার প্রস্রাবের বেগ হতে পারে।
৩) কোমড়ে ব্যথা হতে পারে।
৪) বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
৫) মাসিকের সময় অতিরিক্ত ও অনিয়মিত রক্তপাত হতে পারে।
৬) এই সিস্টের কারণে ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে, ফলে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে চকলেট সিস্ট হলেও কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না।
চকলেট সিস্ট বুঝার জন্যে কি কি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়?
চকলেট সিস্ট নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করে নিশ্চিত হওয়া যায় ।
১) আল্ট্রাসাউন্ড: সাধারণত পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা TVS (Transvaginal Sonography) করে সিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় । এটি একটি সাধারণ এবং প্রাথমিক পরীক্ষা।
২) এমআরআই: যদি আল্ট্রাসাউন্ড থেকে পরিষ্কারভাবে সিস্ট নির্ণয় করা না যায়, তবে এমআরআই (MRI) বা CT Scan করে সিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়।
৩) ল্যাপারোস্কোপি: এটি একটি সার্জিকাল পদ্ধতি, যা সরাসরি অপারেশন করে দেখতে সাহায্য করে যে ডিম্বাশয়ে সিস্ট রয়েছে কিনা। তবে এটি ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য হওয়া সচরাচর করা হয়না।
চকলেট সিস্টের চিকিৎসা
চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর বয়স, সিস্টের আকার-আকৃতি, অবস্থান , সিস্ট কি একপাশে নাকি উভয় ডিম্বাশয়ে, রোগীর কোন সন্তান আছে কিনা, বা এখন বাচ্চা নিতে চাচ্ছেন কিনা, এবং রোগীর উপসর্গের উপর।
এই সবগুলো বিষয় বিচার বিবেচনা করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়। সাধারণত দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে
১) মেডিক্যাল টিট্রমেন্ট
২) সার্জিক্যাল টিট্রমেন্ট
১) মেডিক্যাল টিট্রমেন্টঃ যদি সিস্টের আকার ৩ সে:মি এর ছোট হয় এবং অন্য কোন লক্ষণ না থাকে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ কিছুটা সময় নিবেন। সাধারণত জন্মনিয়ন্ত্রন পিল দিবেন সাথে ব্যথা নাশক ঔষধ দিবেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ওভুলেশন হতে দিবে না ফলে সিস্ট বড় হতে পারবে না এবং ব্যথাও কমে আসবে। তবে এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।
২) সার্জিক্যাল টিট্রমেন্টঃ যদি সিস্টের আকার ৪ সে:মি বা তার চেয়ে বড় হয় এবং অনেক বেশি ব্যথা থাকে সেক্ষেত্রে অপারেশন করতে হয়। যাকে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বলা হয়। তবে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করার পূর্বে আরো কিছু টেস্ট করার প্রয়োজন হয়, যেমন AMH (Anti-Mullerian Hormone) ও TVS (Transvaginal Sonography)। এই দুইটি টেস্ট করে বুঝা যায় একজন মায়ের সন্তান জন্মদানের জন্যে ডিম্বাণুর পরিমাণ কেমন রয়েছে।যেহেতু সিস্ট ডিম্বাশয়ে হয়, এবং সেখানে অপারেশন করলে ডিম্বাশয় এবং ফ্যালোপিয়ান টিউব ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেজন্য অপারেশন করার পূর্বে এধরনের টেস্ট করা হয়।
দুঃখজনক বিষয় হলো, অপারেশন করলেও পরবর্তীতে আবার চকলেট সিস্ট হতে পারে। কারণ অপারেশন করে সিস্ট রিমুভ করা যায় কিন্তু সেখানে থাকে এন্ডোমেট্রিয়াম কোষ গুলোকে পুরোপুরি রিমুভ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তখন আবার এই সিস্ট হতে পারে। সুতরাং অপারেশন ও ১০০% স্থায়ী কোন সমাধান নয়। তবে যদি রোগীর অসহ্য ব্যথা থাকে সেক্ষেত্রে ব্যথার কথা চিন্তা করে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপর।
চকলেট সিস্টের স্থায়ী সমাধান কি?
১) মনোপোজ: মাধারণত মেয়েদের ৪৫ থেকে ৫০ বছর বয়সে মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, মাসিক বন্ধ হওয়াকে মনোপোজ বলে। মনোপোজ এর সময় এটি এমনি ঠিক হয়ে যায়। যেহেতু মাসিকের রক্ত ডিম্বাশয়ে জমা হয়ে সিস্ট তৈরি হয় তাই মাসিক বন্ধ হয়ে গেলে রক্ত ডিম্বাশয়ে জমা হবে না। তখন এটি নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়।
২) ডিম্বগ্রন্থিচ্ছেদন বা ওফোরেক্টমি: অপারেশন করে ডিম্বাশয় কেটে ফেললে চকলেট সিস্ট স্থায়ী ভাবে ঠিক হয়। কিন্তু সমস্যা হলো যে নারীর ডিম্বাশয় কেটে ফেলা হবে, সে নারীর পক্ষে আর কোনদিনই স্বাভাবিক গর্ভধারণ সম্ভব হবে না। এছাড়া ডিম্বাশয় মেয়ের বিভিন্ন হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই সবার বেলায় ডিম্বগ্রন্থিচ্ছেদন বা ওফোরেক্টমি করা যায় না। এধরনের অপারেশনের পূর্বে রোগীর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
চকলেট সিস্ট হলে পরবর্তীতে বাচ্চা নিতে কোন সমস্যা হয় কিনা?
চকলেট সিস্ট ডিম্বাশয় ও ফলোপিয়ান টিউবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফলে বাচ্চা নিতে সমস্যা হতে পারে। চকলেট সিস্ট হলে শতকরা ৪০-৫০% বাচ্চা নিতে সমস্যা হয়। তবে গবেষণা বলছে ৪৩% মহিলারা এই সিস্ট থাকলেও স্বাভাবিক গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা IVF (In Vitro Fertilization) করেও গর্ভধারণের সম্ভবনা রয়েছে।
চকলেট সিস্ট হলে করণীয় কি?
আপনার যদি চকলেট সিস্ট ধরা পড়ে, এবং আপনি যদি গর্ভধারণ করতে চান, তাহলে অবশ্যই গর্ভধারণের জন্যে একজন Infertility specialist এর পরামর্শ নিয়ে প্রেগন্যান্সি প্ল্যান করুন। চিকিৎসক আপনার বয়স, আপনার সিস্টের সাইজ, আপনার ডিম্বাণুর পরিমাণ ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করে আপনার জন্যে যেটা ভালো হবে সেই সিদ্ধান্ত নিবেন, সেইভাবে চিকিৎসা দিবেন। জরুরি নয় যে, এই সিস্ট হলেই আপনাকে অপারেশন করতে হবে, বা আপনার বাচ্চা হবে না। সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রেগন্যান্সি প্ল্যান করা উচিত। সেই সাথে আপনার লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করুন। যেমন,
১) বাহিরের ফাস্টফুড, প্রসেস ফুড, কোমল পানিও খাওয়া বাদ দিতে হবে।
২) অতিরিক্ত শর্করা পরিহার করে, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৩) নিয়মিত ব্যায়াম করুন, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করুন।
৪) প্রতিদিন রাত ৯ টা থেকে সকাল ৫ টার মধ্যে ৬-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যেস গড়ে তুলুন।
৫) মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা পরিহার করেন।
চিকিৎসা না নিলে কি কি সমস্যা হতে পারেঃ
১) মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে
২) সিস্ট বড় হয়ে ফেটে যেতে পারে
৩) ইনফেকশন হতে পারে
৪) infertility বা বন্ধ্যাত্ব হতে পারে
৫) ১% ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
সুতরাং চকলেট সিস্ট হলে অবশ্যই অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রেগন্যান্সি প্ল্যান করবেন।