গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন প্রত্যেক গর্ভবতী মা এবং গর্ভের শিশুর উভয়ের সুস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। গর্ভাবস্থায় শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে হিমোগ্লোবিন না থাকলে গর্ভের সন্তানের ব্রেইন ও হাড় গঠনে সমস্যা হতে পারে। রক্তের হিমোগ্লোবিন শরীরে অক্সিজেন পরিবহণ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, এছাড়া বিভিন্ন মাইক্রো nutrients পরিবহণ করে। যারা গর্ভধারণ করেছেন কিংবা বাচ্চা নিতে চাচ্ছেন তাদের জন্যে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
হিমোগ্লোবিন কি?
আমরা জানি রক্তে ৩ ধরনের কোষ আছে
ক) শ্বেত রক্ত কনিক,
খ) লোহিত রক্ত কনিক,
গ) অনুচক্রিকা। এই লোহিত রক্ত কনিকায় একটি উপাদান থাকে যার নাম “হিমোগ্লোবিন” সহজে বলতে গেলে
“হিমোগ্লোবিন হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন যা লোহিত রক্তকণিকায় (RBC) উপস্থিত থাকে এবং শরীরের টিস্যুগুলিতে অক্সিজেন পরিবহণ করে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির কারণেই রক্ত লাল দেখায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করার মাধ্যমে শরীরের কার্যক্রম সচল রাখতে সহায়তা করে”। রক্তের উৎপাদন লোহিত কণিকা বা হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াকেই রক্ত স্বল্পতা বা রক্তশূন্যতা বলে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন এতে জরুরি কেন?
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন গর্ভের সন্তান এবং মা উভয়ের জন্য জরুরি।
গর্ভের সন্তানের ক্ষেত্রেঃ একজন মা যখন গর্ভধারণ করেন তখন তার শরীরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান, আয়রন এবং রক্তের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, কারণ মায়ের শরীরকে গর্ভস্থ শিশুর জন্য রক্ত তৈরি করতে হয়। গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি থাকলে গর্ভের সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। যার ফলে গর্ভের সন্তানের ওজন কম হয়। এছাড়া গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি থাকলে গর্ভের সন্তানের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। সন্তান হাবাগোবা হতে পারে। সন্তানের রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।
গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রেঃ গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি থাকলে , গর্ভবতী মহিলাদের প্রায়ই ক্লান্তি ও দুর্বলতার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সঠিক পরিবহণ নিশ্চিত করে, যা কোষের কার্যকারিতা ও এনার্জি স্তর ঠিক রাখার জন্য অপরিহার্য। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি থাকলে সময়ের আগে ডেলিভারি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া ডেলিভারির সময় মায়ের শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে ডেলিভারির সময় মায়ের জীবনও ঝুঁকি মধ্যে থাকে। এজন্যেই গর্ভাবস্থায় মায়ে শরীরে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন থাকা জরুরি।
হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রাঃ
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা হলো ১৩-১৮ গ্রাম/ডেসিলিটার এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের ১২-১৬ গ্রাম/ডেসিলিটার। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের জন্য হিমোগ্লোবিনের মান সাধারণত নন-প্রেগন্যান্ট মহিলাদের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা নিম্নরূপ হওয়া উচিত:
- গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে: ১১.০ গ্রাম/ডেসিলিটার বা এর বেশি
- গর্ভধারণের ৪-৬ মাসে: ১০.৫ গ্রাম/ডেসিলিটার বা এর বেশি
এর থেকে কম হলে একে রক্ত স্বল্পতা বলে।
হিমোগ্লোবিন কত হলে রক্ত দিতে হয়?
সাধারণত হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি ৮ গ্রাম/ডেসিলিটার এর কম হয় তখন রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়। তবে গর্ভাবস্থায় রক্ত দেয়া কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় গর্ভবতী মায়ের অবস্থার অবস্থার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসকগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যায় কেন?
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে । যেমন
১) যদি রক্তক্ষরণ হয়ঃ যেহেতু লোহিত রক্ত কণিকা, হিমোগ্লোবিন রক্তেরই অংশ, তাই যেকোনো কারণেই যদি শরীর থেকে রক্ত বের হয় যায় তাহলে, শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা ও হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি হবে ফলে রক্ত স্বল্পতা হবে। এটি হতে পারে কোন দুর্ঘটনা জনিত কারণ, পাইলস, হিমোরয়েড, কোন অপারেশন, যোনিপথে রক্তপাত এমনি মেয়েদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।
২) আয়রন ঘাটতিঃ আয়রন হিমোগ্লোবিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায় কারণ মায়ের শরীরকে গর্ভস্থ শিশুর জন্য রক্ত তৈরি করতে হয়। তাই, আয়রনের অভাব হলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে।
৩) ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি-১২ ঘাটতিঃ লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনের জন্যে ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি-১২ এর প্রয়োজন হয়। এখন শরীরে যদি ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি১২ এর ঘাটতি থাকে তাহলে রক্ত স্বল্পতা হতে পারে। ভিটামিন বি-১২ ও ফলিক অ্যাসিড আমরা সরাসরি পাই খাবার থেকে। আমরা যদি প্রতিদিনের খাবার তালিকায় ভিটামিন বি-১২ ও ফলিক অ্যাসিড জাতীয় কম খাই তাহলে এর ঘাটতি হতে পারে বিশেষ করে যারা vegetarian তাদের সমস্যা হতে পারে। খাওয়ার পরে আমাদের ক্ষুদ্রান্ত থেকে ভিটামিন বি-১২ ও ফলিক অ্যাসিড শোষণ হয়, এখন যদি কারো হজম জনিত সমস্যা যেমন IBS (Irritable BowelSyndrome) থাকে তাহলে এগুলোর ঘাটতি হতে পারে।
৪) এছাড়া কৃমির সমস্যা থাকলেও শরীরে রক্ত স্বল্পতা হতে পারে।
৫) কিছু ঔষধ আছে যেগুলো শরীরে আয়রন শোষণ কমিয়ে দেয় বিশেষ করে গ্যাসের ঔষধ। যারা অতিরিক্ত গ্যাসের ঔষধ খায় তাদের কিন্তু হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হতে পারে।
তো গর্ভাবস্থায় প্রায় সকল মায়েদেরই খাওয়ার অরুচি, বমি হওয়া, গ্যাসের সমস্যা বেশি হয়। যার ফলে পর্যাপ্তা আয়রন ও ভিটামিন জাতীয় খাবার খেতে পারে না। এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে আয়রন চাহিদা থাকে বেশি। একদিকে আয়রনের চাহিদা বেশি অন্যদিকে খেতে না পারা, মূলত এই কারণেই গর্ভাবস্থায় কমবেশি সবার শরীরে হিমোগ্লোবিন বা রক্তের স্বল্পতা দেখা দেয়।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার লক্ষণঃ
১) কিছু লক্ষণ দেখে হিমোগ্লোবিন এর ঘাটতি অনুমান করা যায়। যেমন
সবসময় ক্লান্তি বা অবসাদ লাগা
– শরীর দুর্বল অনুভব হওয়া
– বুক ধড়ফড় করা
– অল্পতেই শ্বাস কষ্ট হওয়া বা অল্প পরিশ্রমে হাপিয়ে যাওয়া
– ত্বক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
– মুখে ও ঠোটে ঘা হওয়া।
– নখ ভঙ্গুর হওয়া
– বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট হওয়া।
– এছাড়া শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া।
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরিক্ষাঃ
সরাসরি রক্তের পরীক্ষা যেমন CBC (Complete Blood Count) অথবা Blood for Hb% টেস্ট করে দেখা যায়। এই ২টি টেস্টের যেকোনো একটি টেস্ট করে যদি দেখেন হিমোগ্লোবিন ১১.০ গ্রাম/ডেসিলিটার বা এর বেশি তাহলে এটি স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। যদি হিমোগ্লোবিন ১১.০ গ্রাম/ডেসিলিটার এর কম থাকে তাহলে বুঝতে হবে আপনার রক্ত স্বল্পতা রয়েছে।
গর্ভাবস্থায় হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধির উপায়ঃ
১) প্রথম উপায় হচ্ছে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার: এমনি কিছু খাবার আছে যেগুলো আপনার শরীরে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করবে। সাধারণত
- লাল শাক,
- পালং শাক,
- কচু শাক,
- কলার মুচি,
- সুবজ ও রঙিন শাক সবজি থেকে আয়রন পাওয়া।
অনেক সময় এগুলো নিয়মিত খাওয়ার পরেও তেমন সুফল পাওয়া যায় না। এর কারণ হলো আয়রন দুই ধরনের হয় একটি হিম আয়রন আরেকটি নন হিম আয়রন। শাক সবজি ফল মূল থেকে সাধারণ নন হিম যুক্ত আয়রন পাওয়া যায়। আমরা যখন শাক সবজি রান্না করি তখন বেশির ভাগ নন হিম আয়রন নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমাদের আয়রনের ঘাটতি থেকে যায় এবং রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়। তাই শাক সবজির পাশাপাশি ফল খাওয়া হচ্ছে বেস্ট অপশন। ফলের মধ্যে,
- আনার,
- কলা,
- পাকা পেঁপে,
- টমেটো, স্ট্রবেরি ইত্যাদি তে প্রচুর পরিমাণ আয়রন ও ভিটামিন বি১২ বিদ্যমান।
অপরদিকে গরুর মাংস, খাসির মাংস, কলিজা, ডিম, সামুদ্রিক মাছ বাদাম, অর্থাৎ যেগুলো প্রথম শ্রেণীর প্রোটিন এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে হিম আয়রন থাকে যা রক্ত স্বল্পতা দুর করতে কার্যকারী ভূমিকা পালন করে।
২. ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি-১২: ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি-১২ হিমোগ্লোবিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে কিছু ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা দেওয়া হলো:
- ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার: সাইট্রাস ফল (লেবু, কমলা), বিনস, মটরশুঁটি, ব্রকলি ইত্যাদি।
- ভিটামিন বি১২ সমৃদ্ধ খাবার: দুধ, ডিম, মাংস, মৎস্য ইত্যাদি।
আমাদের প্রতিদিন ১-৩ mcg ভিটামিন বি-১২ প্রয়োজন হয় ।
৩.ভিটামিন-সি: এই সমস্ত খাবারের সাথে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন
- লেবু,
- কমলা,
- আমলক্ষি ইত্যাদি খেতে হবে।
আপনি যতই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খান, সাথে ভিটামিন-সি জাতীয় খাবার না খেলে শরীরে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি হবে না। কারণ ভিটামিন-সি আয়রন কে শোষনে সহায়তা করে। সুতরাং প্রতিদিন ২-৩ রকম ফল খাবেন এতে করে অন্যান্য ভিটামিন এর চাহিদাও পূর্ণ হবে।
৪. ক্যাফেইন কমানো: চা, কফি এবং অন্যান্য ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় আয়রনের শোষণ কমিয়ে দেয়। তাই, গর্ভাবস্থায় এসব পানীয়ের পরিমাণ সীমিত রাখা উচিত।
৫) সাপ্লিমেন্ট: প্রতিদিন ছেলেদের ৮ মি গ্রাম মেয়েদের ১৪ মি গ্রা আয়রন প্রয়োজন হয়। এছাড়া মেয়েদের পিরিয়ড কিংবা গর্ভাবস্থায় এর চাহিদা ধারায় ২৭ মি গ্রা এর কাছাকাছি। এর মধ্যে ০.৬ মি গ্রা আয়রন প্রতিদিন লস হয়। পিরিয়ডের সময় মেয়েদের ১.৫ মি গ্রা আয়রন লস হয় তাই পিরিয়ড ও গর্ভাবস্থায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আয়রন সমৃদ্ধি খাবার খেতে হবে। এছাড়া সরাসরি আরয়ন ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট নেয়া যায়। গর্ভাবস্থায় প্রায় সবসময় আয়রন জাতীয় ঔষধ খেতে চিকিৎসকের পরামর্শ দিয়ে থাকেন তবু অনেকের হিমোগ্লোবিন কমে যায়। এছাড়া অনেক সময় সরাসরি আয়রন ইনজেকশন দেয়া হয়। যেহেতু ইনজেকশনে সাইড ইফেক্ট বেশি তাই গর্ভাবস্থায় রক্ত বৃদ্ধির জন্যে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার হচ্ছে বেস্ট অপশন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিতঃ
মনে রাখবেন রক্ত স্বল্পতা কোনো রোগ নয় এটি কোন রোগের লক্ষণ তাই
- আপনি যদি রক্ত স্বল্পতার যেকোনো লক্ষণ দেখতে পান।
- গর্ভাবস্থায় কোন কোন প্রকার রক্তক্ষরণ হয়।
- ত্বক ও নখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলে বা বিবর্ণ হয়ে গেলে।
- সামান্য পরিশ্রমে বা বিশ্রাম অবস্থায়ও শ্বাসকষ্ট অনুভব হলে।
এই লক্ষণ গুলো দেখা দিলে অবশ্যই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, অবহেলা করবেন না।