গর্ভধারনের পরে গর্ভাবস্থায় পেট কখন বড় হয় এটি জানার আগ্রহ প্রায় সকল গর্ভবতী মায়েদেরই থাকে। কারন গর্ভধারণের সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে গর্ভের সন্তানের আকার আকৃতি যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি গর্ভবতী মায়ের পেটের আকার আকৃতি ও বৃদ্ধি পায়। তবে কারো পেট আগে বড় হতে দেখা যায় কারো আবার পরে। অনেকেই মনে করে থাকেন, একসাথে গর্ভধারণ হয়েও ঐ ভাবি / আপুর তুলনায় আমার পেট অনেক ছোট কেন। অনেকেই বলে থাকেন, আমার গর্ভধারনের ৪ মাস/ ৫ মাস / ৬ মাস চলছে কিন্তু এখনো পেট দেখা যাচ্ছে না কেন? তো আজকে এই বিষয় গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গর্ভধারন করলে পেট বড় দেখায় কেন?
ছবিটা লক্ষ্য করুন, এটি আমাদের কোমড়ের দুইটি হাড় সংযোগ হওয়ার ছবি। দুইটি হাড় সংযোগ হয়ে যে বৃত্তাকার অংশ তৈরি হয়েছে তাকে বলা হয় pelvic cavity বা pelvis. মেয়েদের জরায়ু সাধারণত এই pelvic cavity এর ভেতর অবস্থান করে। গর্ভধারণ হলে জরায়ুর ভেতরেই বাচ্চা বড় হতে থাকে। যেহেতু pelvic cavity তে খুব বেশি জায়গা নেই। সেজন্য গর্ভের সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে জরায়ু pelvic cavity থেকে উপরের দিকে উঠতে থাকে। উপরে উঠার সাথে সাথে পেটের আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন আমরা বুঝতে পারি পেট বড় হচ্ছে এবং গর্ভের সন্তান বড় হচ্ছে।
গর্ভাবস্থায় পেট কখন বড় হয় ?
গর্ভাবস্থায় পেট কখন বড় হয় বিষয়টা জানতে হলে কিছু বেসিক বিষয় সর্ম্পকে জানতে হবে। কারন গর্ভাবস্থায় পেট কখন বড় হয় এটি বিষয়ের সাথে জড়িত। গর্ভধারণের পুরো সময়টাকে কে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১) First trimester: গর্ভধারনের প্রথম তিন মাস বা ১৩ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টাকে First trimester বলা হয়।
২) 2nd Trimester: গর্ভধারনের ৪-৬ মাস বা ১৪-২৭ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টাকে 2nd trimester বলা হয়।
৩) 3rd Trimester: গর্ভধারনের শেষ তিন মাস বা ২৮-৪০ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়টাকে 3rd trimester বলা হয়।
মূলত গর্ভধারণের ১৬-২০ সপ্তাহ বা 2nd trimester এর গর্ভাবস্থায় পেট বড় হতে শুরু করে। তবে জরুরী নয় যে সবার একই সময়ে পেট বড় হবে। এটি একটি গড় হিসেব মাত্র। অধিকাংশ মহিলাদের এই সময়ের কিছু সপ্তাহ আগে এবং কিছু সপ্তাহ পরেও পেটে বড় হওয়া বুঝতে স্বক্ষম হয় । অনেকেই গর্ভধারণের ৭ মাস বা ২৯ সপ্তাহে পেটের আকার বড় হওয়া বুঝতে পারেন। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে গর্ভের সন্তানের আকার থাকে মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার এবং ওজন হয় মাত্র ১৫-২০ গ্রাম। যার ফলে মায়ের পেটের আকৃতিতে কোন প্রভাব ফেলে না, সেজন্য গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে পেটে বুঝা যায় না। অনেক সময় পেটে বড় হওয়ার সাথে সাথে সামান্য গর্ভাবস্থায় পেটে ও পিঠে ব্যাথা ও হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় পেট ছোট হওয়ার কারন
গর্ভবস্থায় পেট ছোট হওয়ার বেশ কিছু কারন রয়েছে, এগুলোর মধ্যে কিছু স্বাভাবিক কারন আবার কিছু রোগীর জনিত কারনেও হতে পারে। প্রথমে আমরা স্বাভাবিক কারন গুলো জেনে নিবো।
১) প্রথম গর্ভধারণঃ সাধারণত যারা প্রথম মা হতে চলেছেন তাদের পেটে তুলনা মূলকভাবে ছোট হয় ও দেরিতে বড় হয়। আমাদের পেটে মাংসপেশি রয়েছে, এই মাংসপেশি গুলো আমাদের পেটের অভ্যন্তরের অঙ্গ গুলোকে সার্পোট দেয়। যারা প্রথম বার গর্ভধারন করে করেন তাদের পেটের মাংসপেশি গুলো শক্ত থাকে। যার ফলে জরায়ু হালকা বড় হলেও মাংসপেশিগুলোকে প্রসারিত করে সেটা বাহিরে আসতে বেশি সময় লাগে। তখন মনে হয় পেট বড় হচ্ছে না। এই কারনেই যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন তাদের ক্ষেত্রেও পেট দেরিতে বড় হয় বা কম বড় হয়।
২) বয়সঃ আপনি কত বছর বয়সে গর্ভধারন করেছেন এর উপর পেটের আকার নির্ভর করে। যারা কম বয়সে গর্ভধারন করেন তাদের পেটের মাংসপেশি গুলো শক্ত থাকে ফলে তাদের পেট দেরিতে বড় হয় এবং তুলনামূলক ছোট হয়।
৩) যদি আপনার গর্ভে ১ টি বাচ্চা থাকে তাহলে তুলনামূলক ভাবে যাদের গর্ভে জমজ বাচ্চা আছে তাদের তুলনায় ছোট হবে।
৪) সাধারণত যেসকল মায়েরা উচ্চতায় লম্বা তাদের পেট ছোট দেখায় ।
৫) সাধারনত যেসকল মায়েদের ওজন কম শরীর বলা পেটে তেমন কোন চর্বি নেই তারা গর্ভবতী হলে পেট তুলনামূলক ভাবে ছোট এবং দেরিতে বড় হয়।
রোগজনিত কারনঃ
১) গর্ভবস্থায় পেটে পানির পরিমাণঃ গর্ভাবস্থায় বাচ্চা একটা পানি ভর্তি ব্যাগের ভেতরে থাকে এই ব্যাগের নাম amniotic sac আর পানির নাম amniotic fluid or liquor. গর্ভবস্থায় বাচ্চাকে সবধরনের আঘাত রক্ষা করে এই পানি। গর্ভবস্থায় যদি কারো পানির পরিমান কম থাকে তাহলে পেট তুলনামূলক ভাবে ছোট দেখাবে। এই অবস্থাকে মেডিক্যালের ভাষা বলা হয় Oligohydramnios. গর্ভবস্থায় পেটে পানি কম হলে সন্তান ও মায়ের জন্যে বিপদজনক। এই রকম অবস্থাতে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
২) বাচ্চার ওজনঃ কোন কারনে যদি গর্ভের সন্তান পরিপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি না হয় বা স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি না হয় বা Overall Growth & development এ সমস্যা হয় তখন কিন্তু গর্ভবতী মায়ের পেট ছোট দেখাবে। এই অবস্থাকে IUGR (Intrauterine Growth Restriction) বলা হয়। অনেকেই গর্ভবস্থায় পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন না, ফলে বাচ্চার Development ভালো হয়না তখন পেট ছোট দেখায়।
গর্ভবস্থায় পেট অতিরিক্ত বড় হওয়ার কারন
১) দ্বিতীয় বা তৃতীয় গর্ভধারন: যে সকল মেয়েরা দ্বিতীয় বা তার অধিক গর্ভধারণ অর্থাৎ প্রথম গর্ভধারণ নয় তাদের পেট তুলনামূলক ভাবে বড় হয়। কারন দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার গর্ভধারণ হলে পেটের মাংসপেশি গুলো তুলনামূলক কম শক্ত থাকে৷ কারন প্রথম গর্ভধারনের ফলে পেটের মাংসপেশি কিছুটা প্রসারিত হয়ে যায়। তখন জরায়ু হালকা বড় হলেই বাহিরের দিকে চলে আসে এবং পেটবড় মনে হয়। এই কারনেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় গর্ভধারন হলে পেট বড় হওয়া দ্রুত বুঝতে স্বক্ষম হয়।
২) বয়সঃ যারা বেশি বয়সে গর্ভধারণ করেন তাদের পেট বড় হওয়া দ্রুত বুঝতে স্বক্ষম হয় এবং তূলনামূলক বড় হয়।
৩) যাদের গর্ভে জমজ বাচ্চা আছে তাদের পেট স্বাভাবিক ভাবেই যাদের পেটে একটি বাচ্চা তাদের তুলনায় বড় হবে।
৪) উচ্চতাঃ যেসকল মায়েরা উচ্চতায় খাটো তাদের পেট তুলনামূলক ভাবে বড় দেখায় ।
৫) যাদের ওজন বেশি বা পেট বড়, তাদের পেটে সাধারণত পেটে চর্বি থাকে। যার ফলে জরায়ুর আকার সামান্য বড় হলেই পেট বড় দেখায়। বিষয়টা এমন না যে তার গর্ভের সন্তান বেশি বড় হচ্ছে, তার সন্তান হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই বড় হচ্ছে কিন্তু তার পেটের চর্বির কারনে পেট তুলনা মূলক বড় দেখাচ্ছে।
৬) গর্ভবস্থায় মায়ের পেটে যদি পানির পরিমাণ বেশি থাকে তখন থাকে বলা হয় ployhydromonias. যাদের গর্ভবস্থায় পেটে বেশি পানি থাকে তাদের পেট বড় দেখাবে। গর্ভবস্থায় পেটে পানি বেশি হলে সন্তান ও মায়ের জন্যে বিপদজনক। এই রকম অবস্থাতে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৭) গর্ভবস্থায় গর্ভের সন্তান যদি অতিরিক্ত ওজন হয়ে যায় তখন স্বাভাবিক ভাবেই পেট বড় দেখাবে। বিশেষ করে যাদের ডায়বেটিস আছে তাদের বাচ্চার ওজন বেশি হয়ে যায়। এছাড়া অনেই গর্ভবস্থায় অতিরিক্ত খায় যায় ফলে মোটা হয়ে যায় ফলে পেট বড় দেখায়।
৮) কোন কোন ক্ষেত্রে যদি জরায়ুতে টিউমার সহ গর্ভধারন করে সেক্ষেত্রেও পেট তুলনামূলক বড় দেখাবে।
গর্ভাবস্থায় পেট ছোট কিংবা বড় হলে আমাদের কি করনীয়?
১) গর্ভবস্থায় আপনার পেট ছোট কিংবা বড় এটা তুলনা করা বন্ধ করুন। কারন সবার পেট একরকম হয়না, গর্ভবতী মায়ের পেটের আকার এবং গঠন প্রক্রিয়া প্রতিটি মায়ের জন্যে আলাদা হয়ে থাকে। তাই যখনই তুলনা করতে যাবেন তখন আপনার ভেতরে সংশয় তৈরি হবে।
২) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গর্ভবস্থায় একজন গর্ভবতী মা কমপক্ষে ৪ বার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চেকআপ করানো উচিত।
প্রথম চেকআপ: গর্ভধারনের ১২ সপ্তাহের মধ্যে,
দ্বিতীয় চেকআপ: গর্ভধারনের ২০-২২ সপ্তাহের মধ্যে,
তৃতীয় চেকআপ: গর্ভধারনের ২৮-২৯ সপ্তাহের মধ্যে
চর্তুথ চেকআপ: গর্ভধারনের ৩৬ সপ্তাহের পরে অবশ্যই
উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই একজন গর্ভবতী মা চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন এবয় আল্ট্রাসনোগ্রাফি করবেন। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে যদি দেখেন আপনার গর্ভের সন্তানের ওজন, পেটের পানি, অন্যান্য সবকিছু স্বাভাবিক আছে, তাহলে পেট বড় কিংবা ছোট এসব নিয়ে কোন দুঃচিন্তার কারন নেই। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রির্পোটে কোন সমস্যা আসলে চিকিৎসকের পরার্মশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
৩) গর্ভবস্থায় অতিরিক্ত খাবার পরিহার করে, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাবেন। অনেকেই মনে করেন গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত খেতে হবে, তখন অতিবিক্ত খাবার গ্রহনের হলে তার ওজন বৃদ্ধির পাশাপাশি নানান জঠিলতার সৃষ্টি হয়। তাই গর্ভবস্থায় অতিরিক্ত খাবার পরিহার করে, নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
৪) নিয়মিত হাঁটাচলা ব্যায়ম করতে হবে।
৫) গর্ভাবস্থায় যেকোন অসুবিধা মনে হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তো আশা করবো গর্ভাবস্থায় পেট কখন বড় হয় এই সর্ম্পকে আপনারা একটা ধারনা পেয়েছেন।