গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক?

সেয়ার করুনঃ

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। গর্ভাবস্থার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গর্ভবতী মায়ের পেটে ব্যাথা হয়ে থাকে। গর্ভধারনের বয়স যখন বৃদ্ধি পায় তখন গর্ভের সন্তানও বড় হতে থাকে। গর্ভধারনের সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে পেটে ব্যাথার ধরনও পরিবর্তন হয়। সেই সময় জরায়ুর আকার পরিবর্তনের কারনেও পেটে ব্যাথা হতে পারে৷ গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক, আবার কখনো কখনো জঠিল সমস্যার কারনেও হতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হলো আপনি কিভাবে বুঝবেন তবে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক। তো আজকে এই বিষয় গুলো নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করবো।

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা কেন হয়?

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক উভয় কারনেই হতে পারে। প্রথমে আমরা স্বাভাবিক কারন গুলো নিয়ে আলোচনা করবো

১) ইমপ্লান্টেশন বা গর্ভরোপনঃ

ওভুলেশন এর সময় যখন মিলন করা হয় তখন মেয়েদের ডিম্বানুর সাথে ছেলেদের শুক্রানু মিলিত হয়ে একটা ভ্রুনের সৃষ্টি করে। সেই ভ্রুনটি জরায়ুর ভেতরের অংশ ইন্ডোমেট্রিয়ামর এসে বসে যায়, যাকে ইমপ্লান্টেশন বা গর্ভরোপন বলা হয়। সেই ইমপ্লান্টেশনের সময় পেটে হালকা ব্যাথা হতে পারে। যদিও ইমপ্লান্টেশন এর ব্যাথা প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজেটিভ আসার আগেই হয়ে থাকে। সাধারণত মাসিকের কাছাকাছি সময় এই ব্যাথাটি হয়ে থাকে। যদি মাসিকের ২-৩ দিন আগে হালকা পেটে ব্যাথা হয়, এবং এর পরে যদি মাসিক না হয়, তাহলে অবশ্যই আপনাকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। ১০ দিনের মধ্যে পিরিয়ড না হলে অবশ্যই গর্ভধারণের টেস্ট করতে হবে ।

২) পেটে কামরানো বা চিনচিন ব্যাথাঃ

গর্ভধারনের ফলে ভ্রুণটি যখন জরায়ুতে বসে যায় তখন জরায়ুর ভেতরে ভ্রুনটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। জরায়ুর আকার বৃদ্ধির কারনে মাঝে মাঝে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। যদিও এইধরনের ব্যাথা গর্ভধারনের প্রথম তিন মাস বুঝা যায় না। এই ব্যাথা সাধারনত পেটের নিচের দিকে হয় এবং কিছুক্ষন রেস্ট নিলে বা আপনাআপনি ঠিক হয়ে যায়।

৩) পেটে গ্যাস এবং কোষ্ঠকাঠিন্যঃ

গর্ভধারনের ফলে একজন নারীর শরীরে বেশ কিছু হরমোনের তারতম্য ঘটে। এর মধ্যে প্রোজেস্টেরন হরমোন অন্যতম। এই হরমোনের প্রভাবে পেটে গ্যাসের সমস্যা হয়, হজমে সমস্যা হয়, বায়ুর সমস্যা দেখা দেয় ৷ যার ফলে গর্ভবতী মায়েদের পেটে ব্যাথা বা অস্বস্তি হতে পারে। এছাড়া হরমোনের কারনে অনেকের কৌষ্ঠকাঠন্য বা কষা পায়খানা হতে পারে। যার কারনেও গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। সমাধাণঃ এই সমস্যা সমাধানের জন্যে পর্যাপ্ত পানি পান করুন, প্রতিদিন ১০-১২ গ্লাস পানি খেতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্যে খাদ্যতালিকায় আঁশযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে ইসুগুলের ভুসি ২ চামচ করে আধা গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পরে খেতে পারেন। খুব বেমি সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গ্যাসের ঔষধ এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের ঔষধ সেবন করা যেতে পারে।

৪) রাউন্ড লিগামেন্টে ব্যাথাঃ

গর্ভধারনের পরে বাচ্চা জরায়ুর ভেতরেই বড় হতে থাকে। এই জরায়ু কে সার্পোট দেয়ার জন্যে জরায়ুর দুই পাশে ২ লিগামেন্ট (এক ধরনের সুতার মতো টিস্যু) সংযুক্ত থাকে যাকে Round ligament বলে। গর্ভধারনের যখন জরায়ুর আকার বৃদ্ধি পায় তখন এই round ligament এ টান পড়ে যার ফলে গর্ভবতী মা পেটে ব্যাথা অনুভব করে। এই ব্যাথা সাধারন গর্ভধারনের ৫-৬ মাসের সময় দেখা যায়। এই ব্যাথা হঠাৎ শুরু হয় আবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজে নিজেই কমে যায়।

৫) Braxton hicks contraction:

গর্ভধারনের শেষ তিন মাসে জরায়ু ডেলিভারির জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে। সেই সময় জরায়ুতে একধরনের সংকোচন তৈরি হয়। ফলে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হয়। এই ব্যাথার ধরন খুব বেশি তীব্র হয় না, হাঠাৎ করে পেটে সংকোচন বা টান অনুভুত হয় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঠিক হয় যায়। এই সংকোচন বা ব্যাথার সাথে পেট শক্ত অনুভুত হতে পারে। এই ব্যাথা অনেকটা মাসিকের ব্যাথার মতো হতে পারে। এই ছিলো গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথার স্বাভাবিক কারন গুলো।

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথার অস্বাভাবিক কারনঃ

১) মিসক্যারেজ বা গর্ভপাতঃ

গর্ভধারনের ২৮ সপ্তাহের আগেই যদি গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায় বা মারা যায় তখন তাকে মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত বলে। গর্ভপাতের কারনেও গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। গর্ভপাত সাধারণত গর্ভধারনের প্রথম ৩ মাসে সবচেয়ে বেশি হয়। তবে স্বাভাবিক পেটে ব্যাথার সাথে গর্ভপাতের পার্থক্য রয়েছে। গার্ভপাতের কারনে পেটে ব্যাথা হলে যে লক্ষগুলো দেখা দেয় সেগুলো হলো

  • ব্যাথা তুলনামূলকভাবে বেশি হবে, অনেকটা তীব্র ব্যাথা।
  • ব্যাথার সাথে হালকা রক্তপাত বলা রক্তের চাকা দেখা যেতে পারে।
  • এর সাথে গর্ভধানের লক্ষণগুলো হঠাৎ করে কমে যেতে পারে।

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথার সাথে এই লক্ষণ গুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে এটা গর্ভপাতের লক্ষণ হতে পারে। তখন দ্রুত একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

২) Ectopic pregnancy:

গর্ভধারন হলে সাধারনত ভ্রুনটি জরায়ুতে বড় হয়। কিন্তু কোন কারনে যদি ভ্রুনটি জরায়ুতে বড় না হয়ে জরায়ুর বাহিরে যেমন ডিম্বাশয়, ফেলোপিয়ান টিউবেঘ বড় হয় তখন তাকে ectopic pregnancy বলে। এটি একটি মারাত্মক গর্ভধারন। কারন ectopic pregnancy হলে গর্ভের সন্তানকে যেমন বাচানো সম্ভব হয়না। অন্যদিকে সময় মতো ব্যবস্থা না নিলে মায়ের জীবন পর্যন্ত ঝুকিপূর্ণ হয়ে যায়। Ectopic pregnancy এর লক্ষ্যণ গুলো মূলত গর্ভধারনের ৪-১২ সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয়। Ectopic pregnancy এর লক্ষণগুলো হলো

  • পেটে তীব্র ব্যাথা হতে থাকে
  • পস্রাব পায়খানা করার সময় পেটে ব্যাথা হতে পারে।
  • অনেক সময় রক্ত বা বাদামী রঙের তরল পদার্থ নিঃসৃত হতে পারে।
  • অনেক সময় অতিরিক্ত বমি হতে পারে।

এসবের মধ্যে কোন একটি লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে আল্ট্রাস্নোগ্রাম করতে হবে।

৩) প্রস্রাবে ইনফেকশনঃ

গর্ভধারনের ফলে একজন নারীর পস্রাবের ইনফেকশনের চান্স থাকে সবচেয়ে বেশি। পস্রাবে ইনফেকশন হলেও গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। তবে পস্রাবে ইনফেকশন হলে পেটে ব্যাথার সাথে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় সেগুলো হচ্ছে

  • পস্রাব করার সময় ব্যাথা বা জ্বালাপোড়া হওয়া
  • ঘন ঘন পস্রাব হওয়ার
  • পস্রাব আটকে রাখতে না পারা।
  • পেটের নিচের দিকে ব্যাথা হওয়া এবং
  • গায়ে কাপুনি জ্বর আসা। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে প্রস্রাবে ইনফেকশন হয়েছে।

সমাধানঃ প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া কমাতে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। পস্রাবের জ্বালা বা ইনফেকশন কমাতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১২ গ্লাস পানি খেতে হবে এবং একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কিছু এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।

4) Abruptio placenta:

গর্ভাবস্থায় গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভের শিশু মায়ের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান, অক্সিজেন গ্রহণ করে। ফুল মায়ের জরায়ুর দেয়ালের সাথে লেগে থাকে। কিন্তু কোন কারনে যদি গর্ভফুল জরায়ুর দেয়াল থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সড়ে যায় তখন তাকে Abruptio placenta বলে। এই অবস্থায় গর্ভবতী মায়ের যোনিপথে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি পেটে তীব্র ব্যাথা হয়ে থাকে। সবসময় ২০ সপ্তাহ বা তার পরে এই সমস্যা টি দেখা যায়। এটিও মা এবং গর্ভের সন্তান উভয়ের জন্যই মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ। এই লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

৫) Pre-Eclampsia:

সাধারণত গর্ভধারনের ২৮ সপ্তাহ পরে হাঠাৎ করেই রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, তাকে pre-eclampsia বলে। এর ফলে গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হতে পারে। বিশেষ করে পেটের উপরের অংশে ব্যাথা হয়ে থাকে। pre-eclampsia হলে পেটে ব্যাথার সাথে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়, সেগুলো হলোঃ- ক) মাথা ব্যাথা খ) চোখে ঝাপসা দেখা বা চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া (গ) হাত, পা, মুখ ফুলে যাওয়া ইত্যাদি এই লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে

৬) অকাল প্রবাস বা preterm labour:

সাধারনত গর্ভধারনের বয়স ৩৮-৪০ সপ্তাহ মধ্যে বাচ্চা প্রসব হয়ে থাকে। যদি কারো ৩৭ সপ্তাহের আগেই প্রসব ব্যাথা হয় তাহলে তাকে অকাল প্রসব বা preterm labour বলা হয়। Preterm labour এর লক্ষণ গুলেনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো.

  • পেটে, পিঠে, কামড়ে ধরার মতো হালকা থেকে তীব্র ব্যাথা হওয়া। প্রচুর সংকোচিত ব্যাথা, মনে হবে কিছু কামড়ে ধরছে।
  • যোনি পথে আঠালো তরল পদার্থ, বা রক্ত মিশ্রিত স্রাব যাওয়া।
  • যোনি পথে পানি ভাঙ্গা
  • বাচ্চার নড়াচড়া কমে যাওয়া ইত্যাদি। ৩৭ সপ্তাহের আগে এই গুলো দেখা দিলে হতে পারে সেটা অকাল প্রসব ব্যাথা। তাহলে অবশ্যই একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তো এই ছিলো গর্ভবস্থায় পেটে ব্যাথার স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কারণ গুলো।

গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হলে কখন ডাক্তার দেখানো উচিত?

কোন কোন লক্ষণ দেখে লিখে আপনাকে দ্রুত একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

  • যদি হঠাৎ করে পেটে তীব্র ব্যাথা হয়।
  • পেটে ব্যাথার সাথে যদি যোনি পথে রক্তপাত হয়।
  • যদি যৌনি পথে অতিরিক্ত সাদা স্রাব, রক্ত মিশ্রিত স্রাব, কিংবা দুধর্গন্ধ জাতীয় স্রাব হয়।
  • মাথা ব্যাথা, চোখ ঝাপসা দেখা দিলে ।
  • বাচ্চার নড়াচড়া কমে গেলে ।
  • পাতলা পায়খানা বলা কোষ্ঠকাঠিন্য বা পায়খানার সাথে রক্ত গেলে।
  • প্রস্রাবের সময় জ্বালা পোড়া বা ব্যাথা হলে।
  • গায়ে জ্বর হলে
  • যোনি পথে কমে বেশি পানি ভাঙ্গলে.
  • গর্ভবতী মায়ের শরীরে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে ।

এই ১০ লক্ষ্যের ১টিও যদি আপনি পেটে ব্যাথার সাথে দেখেন তাহলে একমুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অন্যথায় বাচ্চা এবং মা উভয়ের জন্য বিপদ হতে পারে।

আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ

1 thought on “গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক?”

  1. Pingback: গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি কতবার করা উচিত?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *