গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি কতবার করা উচিত?

সেয়ার করুনঃ

গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি কতবার করা উচিত? সকল গর্ভবতী মায়েদের মনেই এই প্রশ্নটি আসে। কেননা গর্ভধারণের পরে যখনই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া হয়, মোটামোটি ততবারই ডাক্তার আপনাকে আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিয়ে থাকনে। অনেকেই জানতে চান গর্ভাবস্থায় বার বার আলট্রাসনোগ্রাফি করলে বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় কিনা?

আলট্রাসনোগ্রাফি কী?

আলট্রাসনোগ্রাফি এক ধরনের পরীক্ষা, যা বিশেষ শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের অংশের ছবি দেখা যায়। এই ছবি গুলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে উঠে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন কিছু শনাক্ত করা হয়, একেই মূলত আল্ট্রাসনোগ্রাফী বলে। অনেকসময় এই পরিক্ষাটিকে সনোগ্রাফী, আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা বা আলট্রাসনোগ্রাফী বা আল্ট্রাসাউন স্ক্যান বলা হয়।

গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি কতবার করা উচিত?

একজন গর্ভবতী মায়ের পুরো pregnancy তবে কমপক্ষে তিনবার গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি করা পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কমপক্ষে ৩ বার করা উচিত। কখন এবং কেন ৩ বার করা উচিত? বুঝিয়ে বলছি

প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফিঃ

সাধারণত গর্ভধারনের ১০-১২ সপ্তাহের মধ্যে প্রথম গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফিকরানো উচিত। ৮ সপ্তাহের আগে আল্ট্রাসনোগ্রাফী করলে অনেক সময়ে সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না। তাই এই সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরিক্ষা অত্যান্ত জরুরি। কারন প্রথম আল্ট্রাসাউন্ডে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। যেমন:

১) সাধারনত গর্ভধারনের পরে ভ্রূণটি জরায়ুর ভেতরের অংশ endometrium এর এসে বসে যায়। কিন্তু কোন কারনে যদি ভ্রুনটি জরায়ুর ভেতরের অংশ endometrium এ না বসে অন্য কোথাও বসে তখন তাকে Ectopic pregnancy বলা হয়। যা একটা মারাত্মক গর্ভধারন। Ectopic pregnancy হলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে গর্ভের শিশুটি বাঁচতে পারে না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে মায়ের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

২) গর্ভধারনের পরে ভ্রুনটি যখন জরায়ুতে বসে যায় তখন বাচ্চার জন্যে একটা ঘরে তৈরি হয় যাকে মেডিক্যালের ভাষায় fetal sac বা fetal pol বলে। অনেক সময় দেখা যায় pregnancy test positive আসার পরে বাচ্চার ঘরে হয়, কিন্তু ঘরে বাচ্চা থাকে না। আবার বাচ্চার থাকলেও হার্ট বিট আসে না, যাকে মেডিক্যালের ভাষা blighted ovum বলে। ১২ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চার হার্টবিট না আসলে তখন কিন্তু pregnancy টা কন্টিনিউ করা সম্ভব হয় না, মিসক্যারেজ করাতে হয়। ৩) এছাড়া আপনার গর্ভে জমজ বাচ্চা আছে কিনা সেটি বুঝা যায়।

৪) আপনি কত সপ্তাহের গর্ভবতী, ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ কবে জানা যায়।

৫) গর্ভের শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি না

৬) শিশুর মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্কের বিকাশ স্বাভাবিক ভাবে হচ্ছে কিনা এই সকল বিষয় গুলো গর্ভধারনের ১০-১২ সপ্তাহে আল্ট্রাসনোগ্রাফী করলে বুঝা যায়।

দ্বিতীয় আলট্রাসনোগ্রাফিঃ

গর্ভাবস্থার ১৮–২২তম সপ্তাহে বা ৫ ম মাসে দ্বিতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর উচিত। এই সময়ের  আল্ট্রাসনোগ্রাফীকে‘অ্যানোমালি স্ক্যান‘ বলা হয়। অন্তত একবার গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করালেও এই সময়ে করানোর উচিত। এই সময়ে আলট্রাসনোগ্রাফিতে শিশুর মুখমণ্ডল, হাত-পা, পেট ও নাড়িভুঁড়ি, হাড়, হার্ট, কিডনি, ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্র স্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। এই স্ক্যানে অনেকগুলো তথ্য পাওয়া যায়। যেমন—

১) গর্ভের শিশুর কোনো ধরনের জন্মগত ত্রুটি আছে কি না

২) শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি না

৩) শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হারে চলছে কি না

৪) গর্ভের শিশুর আকার ও ওজন স্বাভাবিক আছে কিনা

৫) গর্ভের শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে।

৬) গর্ভফুল স্বাভাবিক পজিশনে আছে এই সকল তথ্য পাওয়া যায় ৫ ম মাসে আল্ট্রাস্নোগ্রাফী করলে।

 তৃতীয় আলট্রাসনোগ্রাফিঃ

গর্ভাধারণের ৩৬–৩৮ সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি করা উচিত। এই স্ক্যানে প্রসবের আগে গর্ভের শিশু ও গর্ভফুলের অবস্থান দেখা যায়। এই সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফী করলে, নরমাল ডেলিভারি হবে নাকি সিজারিয়ান ডেলিভারি হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। এই স্ক্যানে অনেকগুলো তথ্য পাওয়া যায়। যেমন—

১) গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার অবস্থানঃ গর্ভাবস্থায় গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভের শিশু প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি শোষণ করে। সাধারণত গর্ভফুল জরায়ুর উপরের দিকে থাকে। কিন্তু গর্ভফুলের অবস্থান স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে আসলে তাকে low lying placenta বলে। এছাড়াও ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’ নামক মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। গর্ভফুলের এমন সমস্যা থাকলে নরমাল ডেলিভারি করা ঝুকিপূর্ন। সেক্ষেত্রে সিজারের সাহায্যে ডেলিভারিসহ বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে। তাই এই সময় গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করা উচিত।

২) বাচ্চার পজিশনঃ সাধারনত গর্ভধারনের ৩৬ সপ্তাহরের পর থেকে গর্ভের সন্তান ডেলিভারীর জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে। এই সময় বাচ্চার মাথা নিচের দিকে থাকে ডাকে বৱা হয় cephalic presentation। কিন্তু ৩৬ সপ্তাহের পরে গর্ভের শিশু যদি লম্বালম্বি, আড়াআড়ি অথবা কোণাকুণি বা মাথা নিচের দিকে না থাকে তখন তাকে breach presentation বলে। ছবিটি লক্ষ্য করুন। ৩৬ সপ্তাহের পরে গর্ভের সন্তান cephalic presentation না থাকলে নরমাল ডেলিভারির সম্ভব হয়না। তখন সিজারিয়ান ডেলিভারির প্রয়োজন হতে পারে।

 ৩) গর্ভবস্থায় শিশু একটা পানি ভর্তি ব্যাগের ভেতর থাকে। এই পানিকে বলা হয় amniotic fluid, এই সময় আল্ট্রা করে গর্ভের শিশুর চারপাশে থাকা ‘অ্যামনিওটিক তরল’ এর পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ এটি পরিমাণে বেশি বা কম হলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং নরমাল ডেলিভারির সমস্যা হতে পারে।

৪) এছাড়া গর্ভাবস্থায় পেটে ব্যাথা হলেও শিশুর নড়াচড়া লক্ষ্য রাখা জরুরী। গর্ভের শিশু ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না সেটাও এই সময় আল্ট্রাসনোগ্রাফি করলে বুঝা যায়। এই জন্যেই গর্ভধারনের পুরো সময়ে অন্তত এই ৩ সময় আল্ট্রা করানো উচিত।

তবে কোন বিশেষ প্রয়োজন হলে ৩ বারের বেশি গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

আলট্রাসনোগ্রাফি করার পূর্বে  কি করনীয়?

গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি করার আগে তেমন কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না । তবে যদি, গর্ভধারনের ৫–১৪ সপ্তাহের মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাফি করা হয় তাহলে কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন

১) আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার আগে যথেষ্ট প্রস্রাবের চাপ থাকতে হয়, সেজন্য আলট্রাসনোগ্রাফি ১ ঘন্টা আগে আধা লিটার থেকে ১ লিটার পানি অথবা তরল খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এর কারণ হলো, এই সময় গর্ভের শিশু আকারে খুবই ছোট থাকে, এই সময় প্রস্রাবের চাপ থাকলে গর্ভের শিশুর তথ্যগুলো ভালোভাবে নির্ণয় করতে সাহায্য করে।

২) ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করা । কারন, আলট্রাসনোগ্রাফির জন্য প্রথমে আপনার বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত থাকা কাপড় সরিয়ে নিয়ে তলপেটের ওপর আলট্রাসাউন্ড জেল লাগানো হবে। তারপর আলট্রাসনোগ্রাফি প্রোবের সাহায্যে আপনার পেটের বিভিন্ন অংশের ওপর চেপে চেপে পরিক্ষাটি করা হবে।

৩) ভয়ের কিছু নেই আলট্রাসনোগ্রাফির সময়ে সাধারণত কোনো ব্যথা লাগে না। তবে ডাক্তার কখনো কখনো ভালোমতো দেখার জন্য পেটে সামান্য চাপ দিতে পারেন। এতে ব্যথা না হলেও কিছুটা অস্বস্তি হতে পারে।

গর্ভবস্থায় ঘন ঘন আলট্রাসনোগ্রাফি করলে বাচ্চা কোন ক্ষতি হয়?

 উত্তর হচ্ছে না। যেহেতু আলট্রাসনোগ্রাফিতে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়, এবং এতে কোন ক্ষতিকর রশ্মি থাকে না। সেজন্য ঘন ঘন আল্ট্রা করলে গর্ভবতী মায়ের এবং বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় না। সুতরাং একজন গর্ভবতী মায়ের পুরো pregnancy তবে কমপক্ষে তিনবার আলট্রাসনোগ্রাফি করানো উচিত। ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি হলেও সমস্যা নেই।

আলট্রাসনোগ্রাফিতে গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে বুঝা যায়?

সাধারনত গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ বা ৫ মাসের পরে আলট্রাসনোগ্রাফি করলে বুঝা যায় গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে। গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ বা ৫ মাসের আগে বুঝা যায় না। তবে অনেক সময় গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ বা ৫ মাসের পরেও বাচ্চার পজিশন উল্টো থাকলে গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে বুঝা সম্ভব হয় না।

গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি রির্পোট বুঝার উপায়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *