যারা বাচ্চা নেয়ার জন্যে চেষ্টা করছেন, তাদের ওভুলেশনের লক্ষণ ও গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা অত্যান্ত জরুরী। কেননা ওভুলেশনের সময় মিলন করলে গর্ভধারন হয়। একজন সুস্থ্য নারীর প্রতিমাসে যেমন মাসিক বা ঋতুস্রাব হয় ঠিক তেমনি প্রতিমাসে ওভুলেশন হয়। কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা বুঝতেই পারেন না কখন তার ওভুলেশন হচ্ছে। তখন দেখা যায় বার বার চেষ্টা করেও গর্ভধারন হচ্ছে না। আবার কখনো বিভিন্ন সমস্যার কারনেও ওভুলেশন হয় না।সাধারনত মাসিক হলে রক্তপাত দেখে সহজেই বুঝা যায় মাসিক বা ঋতুস্রাব হয়েছে নাকি হয়নি। কিন্তু ওভুলেশন সময় তো আর রক্তপাত হয় না, তাহলে ওভুলেশন হচ্ছে কিনা বুঝার উপায় কি? তো আজকে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে আপনি সহজেই আপনার ওভুলেশন বা ডিম্বপাতের সময়টি বের করবেন।
ওভুলেশন কি?
ইংরেজিতে ”ওভুলেশন (Ovulation)” এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে “ডিম্বস্ফোটন” মেয়েদের জরায়ুর ২ পাশে ২ টি ওভারি বা ডিম্বাশয় থাকে।এই ডিম্বাশয়ে মূলত বাচ্চা হওয়ার জন্যে ডিম্বাণু জমা থাকে।মাসিক চক্র অনুযায়ী মাসিকের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মেয়েদের ডিম্বাশয় থেকে বাচ্চা হওয়ার জন্যে ডিম্বাণু বের হয়। ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বের হওয়াকেই মূলত বলা হয় ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন বা ডিম্বপাত। এই ওভুলেশনের সময় যদি কেউ মিলন করে তাহলে ছেলেদের শুক্রানুর সাথে মেয়েদের ডিম্বাণু মিলিত হয়ে একটি ভ্রুনের সৃষ্টি হয়। এভাবে গর্ভধারন হয়। তাহলে বুঝতেই পারছেন ওভুলেশন ব্যাতীত গর্ভধারন সম্ভব নয়।
কখন মেয়েদের ওভুলেশন হয়?
ওভুলেশন নির্ভর করে মেয়েদের মাসিকচক্র বা menstrual cycle এর উপর। প্রত্যেক নারীদের মাসিক চক্র যেমন আলাদা তেমনি প্রত্যেকের ওভুলেশনের সময় ও আলাদা হয়ে থাকে। মাসিক চক্র অনুসারে ওভুলেশন ডে গণনা করতে হবে। ওভুলেশনের ডে গননা করার সূত্র হলো Menstrual cycle – 14. অর্থাৎ মাসিক চক্র বের করে সেখান থেকে ১৪ দিন বিয়োগ করলে ওভুলেশন ডে বের হয়ে যাবে। তবে আরো কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। বুঝিয়ে বলছি।প্রথমে আপনি একটি ক্যালেন্ডার নির্বাচন করুন, তারপর যেদিন আপনার মাসিক শুরু হয়েছে সেই দিনটি চিহ্নিত করুন। মনে করুন আপনার ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে।তারপর আপনার মাসিক কতদিন পর পর হয় বা আপনার মাসিক সাইকেল কতদিনের তা থেকে ১৪ দিন বিয়োগ করুন। উদাহারন দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছি।
উদাহরণ-১ঃ
ধরুন আপনার মাসিক চক্র হিসেব করে দেখলেন আপনার ২২ দিন পর পর মাসিক হয়।তাহলে আপনার ভুলেশন বা ডিম্বপাতের সময় হলো ২২-১৪ = ৮। তাহলে আপনার মাসিকের ৮তম (অষ্টম) দিন টি হলো আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়। ৮ তম দিন হিসেব করতে হবে মাসিক শুরুর দিন থেকে। অথার্ৎ ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে তাহলে আপনার ৮ তারিখ হচ্ছে মাসিকের ৮ম (অষ্টম) দিন।এখন এই ৮ তম দিনের সাথে ২-৩ দিন আগে পরে যোগ-বিয়োগ করে নিন। ৮ তারিখ থেকে ২ দিন যোগ বিয়োগ করলে হয় ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম দিন।সুতরাং আপনার যদি প্রতিমাসে ২২ দিন পরপর মাসিক হয় তাহলে মাসিকের ৬-১০ তম দিন হচ্ছে আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়। এই সময় আপনি প্রতিদিন বা একদিন পর পর মিলন করলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকবে।
উদাহরণ-২ঃ
ধরুন আপনার ৩০ দিন পর পর মাসিক হয়। তাহলে আপনি কিভাবে ওভুলেশনের সময় গণনা করবেন। এক্ষেত্রে আপনার ভুলেশন বা ডিম্বপাতের সময় হলো ৩০-১৪ = ১৬ । তাহলে আপনার মাসিকের ১৬ তম দিন টি হলো আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়। অথার্ৎ ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে তাহলে আপনার ১৬ তারিখ হচ্ছে মাসিকের ১৬ তম দিন।এখন এই ১৬ তম দিনের সাথে ৩ দিন আগে পরে যোগ বয়োগ করে নিন। ১৬ তম দিন থেকে ৩ দিন যোগ বিয়োগ করলে হয় ১৩ থেকে ১৯ তম দিন। সুতরাং আপনার যদি প্রতিমাসে ৩০ দিন পরপর মাসিক হয় তাহলে মাসিকের ১৩-১৯ তম দিন হচ্ছে আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়। এই ৬ টি দিনের যে কোন সময় আপনার ওভুলেশন হতে পারে। এই সময় আপনি একদিন পর পর মিলন করলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি।
উদাহরণ-৩ঃ
ধরুন আপনার ৩৫ দিন পরপর মাসিক হয়। তাহলে আপনার ভুলেশন বা ডিম্বপাতের সময় হলো ৩৫-১৪ = ২১। তাহলে আপনার মাসিকের ২১ তম দিন টি হলো আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়। অথার্ৎ ১ তারিখে মাসিক শুরু হয়েছে তাহলে আপনার ২১ তারিখ হচ্ছে মাসিকের ২১তম দিন। এখন এই ২১ তম দিনের থেকে ৩/৪ দিন আগে পরে যোগ করে নিন। যেহেতু আপনার পিরিয়ড টা বড় তাই সময় টা বেশি করে নিন মানে ১৭ থেকে ২৫ তম দিন। সুতরাং আপনার যদি প্রতিমাসে ৩৫ দিন পরপর মাসিক হয় তাহলে মাসিকের ১৭-২৫ তম দিন হচ্ছে আপনার ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময়।এই সময় আপনি প্রতিদিন বা একদিন পর পর মিলন করলে বাচ্চা হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকবে।
কিভাবে বুঝবেন আপনার ওভুলেশন হচ্ছে কিনা?
আপনার ওভুলেশন বা ডিম্বপাত হচ্ছে কিনা তা বুঝার জন্য কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে পারেন। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ-
ক) ওভুলেশনের লক্ষণ সমূহ
ওভুলেশন সময় বিভিন্ন হরমোনের তারতম্য ঘটে ফলে শরীরে বেশ কিছু ওভুলেশনের লক্ষণ প্রকাশ পায়।ওভুলেশনের লক্ষণ গুলো চিহিৃত করতে পারলে ওভুলেশনের সময়টা বুঝা যায়। ওভুলেশনের লক্ষণ গুলো হচ্ছে,
- শরীরের তাপমাত্রা পাওয়া। ওভুলেশনের সময় শরীরে বিভিন্ন হরমোন বৃদ্ধি পায়, ফলে শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ০.৫ -১ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেতে পারে। মাসিকের সাইকেল অনুযায়ী ওভুলেশনের সম্ভাব্য সময় শুরুর আগের দিনে থেকে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করুন।
কিভাবে তাপমাত্রা পরিমাপ করবেন?
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ডিজিটাল র্থামোমিটার দিয়ে মুখে তাপমাত্রা পরিমাপ করুন। যদি পরপর তিন দিন (০.৩ থেকে ১) ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পায় তাহলে বুঝতে হবে এটি ওভুলেশনের লক্ষণ। তাপমাত্রা দেখে সহবাস শুরু করতে পারেন। পারেন আপনার ওভুলেশন হচ্ছে কিনা।
- ভুলেশনের সময় যোনি পথে এক ধরনের স্রাব নিঃসৃত হয় যা দেখতে স্বচ্ছ, আঠালাে অনেকটা ডিমের সাদা অংশের মত যাকে cervical mucus বলে। এই স্রাব হাতে নিলে কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এই স্রাব গন্ধ ও রঙহীন হবে। এটি ওভুলেশনের লক্ষণ গুলো মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
- ওভুলেশনের সময়ে অনেকেরই স্তনে হালকা ব্যাথা হতে পারে।
- অনেকেরই ওভুলেশনের সময় অন্যান্য সময়ের চেয়ে যৌন চাহিদা তুলনা মূলকভাবে বৃদ্ধি পায়।
- ওভুলেশনের সময় বিভিন্ন হরমোন নিঃসৃত হয়, ফলে মেয়েদের প্রজনন অঙ্গগুলো সংকোচিত হয়, এর কারনে পেটে ব্যাথা হতে পারে।
- ওভুলেশনের সময় মেয়েদের যৌনিপথ তুলনামূলক ভেজা, নরম ও পিচ্ছিল থাকে, যৌনি পথে হাত দিলে সহজেই বুঝা যায়।
- ওভুলেশনের সময় অনেকের স্রাবের সাথে বিন্দু কনার মত রক্ত দেখা যেতে পারে যাকে স্পটিং (spotting) বলে। এর পরিমাণ হবে খুবই সামান্য, এর জন্য কোন স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করতে হবে না।
নোটঃ-
মাসিকের ১০-২০ তম দিন গুলোতে এধরনের লক্ষণ দেখতে পেলে হতে পারে সেটা ওভুলেশনের লক্ষণ। তবে সব ওভুলেশনের লক্ষণ কিন্তু সবার নাও হতে পারে। আপনার কোনগুলো হচ্ছে সেগুলো আপনি মিলিয়ে নিন।
খ) ওভুলেশন টেস্ট কিট
ওভুলেশনের লক্ষণ ছাড়াও ওভুলেশন ডে বের করার জন্যে বাজারে ওভুলেশন টেস্ট কিট পাওয়া যায়। প্রস্রাব টেস্ট করে আপনি সহজেই আপনার ওভুলেশনের সময় বুঝতে পারেন। এটি প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিটের মতোই ব্যবহার করতে হয়।
ওভুলেশনের লক্ষণ প্রত্যেকের হয়?
ওভুলেশনের সময় প্রথেকেরই এসব লক্ষণ দেখা যায় না। অনেকেই কখন অভুলেশন হয় বুঝতেই পারে না। প্রত্যেক নারীর মাসিক সাইকেল যেহেতু আলাদা তাই এই লক্ষণ গুলো প্রত্যেকের আলাদা সময়ে দেখাদিতে পারে।আপনি সব লক্ষণ গুলোর মধ্যে ১-২ টা লক্ষণ আপনার মধ্যর পেতে পারেন।এছাড়া লক্ষণ ছাড়াও ওভুলেশন হতে পারে।সাধারনত মাসিকে ১০ম দিন থেকে ২০ তম দিনের মধ্যে যেকোন সময় এই লক্ষণগুলো দেখা দিবে।আপনি আপনার মাসিকের ১০ম দিন থেকে শুরু করে ২০ তম দিন পর্যন্ত আলোচিত লক্ষণ গুলো খুজবেন, তাহলে পাবেন বুঝতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
কখন বুঝবেন ওভুলেশন হচ্ছে না?
মেয়েদের বিবিন্ন সমস্যার কারনে ওভুলেশন হয় না। কিছু লক্ষণ দেখে আপনি অনুমান করতে পারবেন আপনার ওভুলেশন হচ্ছে না। যেমন
- মাসিক অনিয়মিত হওয়া
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা কম রক্তক্ষণ হওয়া।
- সাদা স্রাব বা cervical mucus না হওয়া।
- অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চা না হওয়া
এই লক্ষণ গুলো যদি আপনার থাকে তাহলে বুঝতে হবে হতে পারে আপনার ওভুলেশনের সমস্যা হচ্ছে ৷ এই সমস্যা গুলো থাকলে অবশ্যই আপনাকে একজন গাইনি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ওভুলেশনের সময় কিভাবে মিলন করবেন?
মেয়েদের ওভুলেশন বা ডিম্বাণু বের হওয়ার পরে ২৪ ঘন্টা জরায়ুতে অবস্থান করে এবং মিলনের পরে ছেলেদের শুক্রানু মেয়েদের যৌনিতে ৫ দিন পর্যন্ত অবস্থান করে। বাচ্চা হওয়ার জন্যে সুস্থ্য শুক্রানুর দরকার। তাই ১ দিন পর পর মিলন করলে শুক্রানুর গুনাগুন ভাল হবে।যেহেতু শুক্রানু মেয়েদের যোনিতে ৫ দিন বেচে থাকে এবং মেয়েদের ডিম্বানু ২৪ ঘন্টা অবস্থান করে। তাই যখন ডিম বের হোক না কেন আপনার বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু থাকবে (ইনশাআল্লাহ)।
ওভুলেশনের আগে পরে ২/৩ দিন যোগ বিয়োগ কেন করবেন?
আমাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কারনে অনেক সময় মাসিক ২/১ দিন আগে কিন্তু পরে হয়ে যায়।তাই ওভুলেশন ও আগে বা পরে হয়ে যেতে পারে।সময়টা বেশি নেয়ার উদ্দেশ্য হলো যেন কোন অবস্থাতেই ওভুলেশন টাইম টা মিস না হয়। এভাবে ওভুলেশন ডে অনুযায়ী মিলন করলে বাচ্চা হওয়ারস ম্ভবনা সবচেয়ে বেশি থাকবে (ইনশাআল্লাহ)।
ওভুলেশন সময় ব্যাতীত মিলন করা যাবে?
অনেকেই কনফিউশানের মধ্যে থাকেন ওভুলেশন ডে শুরু আগে বা পরে মিলন করা যাবে কিনা।অনেকেই মনে করে থাকেন হয়তো ওভুলেশন ডে ব্যাতীত মিলন করা যাবে না। এটি ভুল ধারনা। আপনি ওভুলেশনের আগে পরে যেকোন সময় মিলন করতে পারেন, এতে কোন সমস্যা নেই। ওভুলেশন ডে গণনা করার উদ্দেশ্য হলো কোন ভাবেই যে ওভুলেশনের সময় সহবাস করা মিস না হয়। আপনি অন্য সময় মিলন করুন আর না করুন ওভুলেশনের সময় অবশ্যই মিলন করতে হবে।
এমন কোন ঔষধ আছে যার মাধ্যমে ওভুলেশন হয়?
উত্তর হচ্ছে হ্যা এমন কিছু ঔষধ আছে যেগুলো ডিম্বাণুকে বড় করে ওভুলেশনে সহায়তা করে।এছাড়া কেন ওভুলেশন হচ্ছে না সেসব কারন খুজে বের করে চিকিৎসা নিলে ওভুলেশন হতে পারে। যে কোন ঔষধ খাওয়ার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ওভুলেশন ছাড়াও মাসিক হতে পারে?
আপনার যদি মাসিক নিয়মিত হয় তাহলে ধরে নেয়া যায় আপনার নিয়মিতই ওভুলেশন হচ্ছে। তবে কখনো কখনো মাসিক হলেও ওভুলেশন নাও হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সময় হরমোনের তারতম্যের কারনে ওভুলেশনের সময় ডিম্বানুর আকার ছোট হয়, ফলে গর্ভধারনে সমস্যা হয়। ডিম্বানুর আকার ছোট হলে গর্ভধারনে সমস্যা হয়।
আমাদের সাথে যুক্ত হতে ফলো করুনঃ